সেরা ধনীর সম্পত্তি পাহারা দিত ২ লাখ সৈন্য

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হলেন জেফ বেজোস। যার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৩১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০১৯ সালে ফোর্বসের বিশ্বজোড়া কোটিপতি তালিকার প্রথমে উঠে আসে তার নাম।

জানেন কি, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জেফ বেজোস হলেও তিনি কিন্তু সর্বকালের সেরা ধনী নন। সেই খেতাবের মালিক মানসা মুসা। ১৪ শতকে পশ্চিম আফ্রিকার এই মুসলিম শাসক এতটাই ধনী ছিলেন যে তার দানশীলতার কারণে একটি পুরো দেশের অর্থনীতিতে পর্যন্ত ধস নেমেছিল।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুডলফ বুচ ওয়ার বলেন, ‘মুসার সম্পদের যে শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে আসলে তিনি যে কতটা সম্পদশালী ছিলেন সে ধারণা করাও কঠিন।’২০১২ সালে একটি মার্কিন ওয়েবসাইট ‘সেলিব্রিটি নেট ওর্থ’ তার মোট সম্পদের মূল্য ৪০ হাজার কোটি ডলার বলে একটি ধারণা দেয়। অর্থনীতির ইতিহাসবিদরা এ সংখ্যা দিয়ে তার সম্পদের কোনো সঠিক ধারণা দেওয়া অসম্ভব।

মানসা অর্থ রাজা বা সম্রাট। মুসার পুরো নাম প্রথম মুসা কিতা। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সুলতান হওয়ার কারণে তাকে মানসা খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১২৮০ সালে একটি শাসক পরিবারেই জন্ম মানসা মুসার। তিনি ছিলেন মালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সান্দিয়াতা কিতার ভাগ্নে।

মুসা ক্ষমতায় আসার আগে মালি সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন তার ভাই মানসা আবু-বকর। ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দে আবু-বকর সিংহাসন ত্যাগ করে একটি অভিযানে বের হন। চতুর্দশ শতকের সিরীয় ইতিহাসবিদ শিহাব আল-উমারির বর্ণনা অনুযায়ী, আটলান্টিক মহাসাগর এবং তার ওপারে কী আছে তা নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন আবু-বকর।

বলা হয়, ২ হাজার জাহাজ এবং হাজার হাজার পুরুষ, নারী এবং দাস-দাসী নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমান তিনি। এরপর আর কখনো ফিরে আসেননি। আবু-বকর শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছতে পেরেছিলেন কি-না তার কোনো প্রমাণ নেই।

তার বড় ভাই আবু-বকরের পর মুসা মালির রাজা হন ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। এ বয়সেই তিনি পৃথিবীর বড় একটা অংশের সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক, যিনি ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। তার শাসনামলে তৎকালীন রাজধানী তিম্বুকতুসহ ২৪টি নগর যুক্ত করে মালি সাম্রাজ্য গঠন করা হয়।

মুসার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল ২ হাজার মাইলজুড়ে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে বর্তমান নিজার, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, মালি, বুর্কিনা ফাসো, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি এবং আইভোরি কোস্টের বড় অংশ ছিল তার রাজত্বে। এই বিশাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তার আয়ত্তে আসে মূল্যবান খনিজ সম্পদ- বিশেষ করে স্বর্ণ এবং লবণ।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের হিসাব অনুযায়ী, মানসা মুসার শাসনামলে তৎকালীন বিশ্বে যে পরিমাণ স্বর্ণের মজুত ছিল তার অর্ধেকই ছিল মালিতে। তার সব স্বর্ণের মালিক ছিলেন মানসা মুসা। বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো তার সাম্রাজ্যে স্বর্ণ এবং অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা করত। সেই বাণিজ্য থেকেই সর্বকালে সেরা সম্পদশালী হয়ে ওঠেন মানসা মুসা।

জানলে অবাক হবেন, মুসা তার সম্পদ এবং সাম্রাজ্য দুটোই রক্ষা করত বিশাল সৈন্যবাহিনী করে। তার এই বাহিনীর সদস্য ছিলেন দুই লাখেরও বেশি। যার মধ্যে ৪০ হাজার সৈন্য ছিলেন তীর চালনায় অতি দক্ষ। এ ছাড়া মুসার সেবিকার সংখ্যা ছিল ৫০০ জন। কথিত আছে, প্রতি জুমার দিন একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন তিনি।

ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন মানসা মুসা। তিনি একসময় সাহারা মরু এবং মিশর পার হয়ে মক্কায় হজ পালনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মানসা মুসার মক্কা যাত্রা তাকে এবং মালি দেশকে মানচিত্রে স্থান করে দেয়। জানা যায়, ৬০ হাজার মানুষের একটি দল নিয়ে মালি ত্যাগ করেন মুসা।

সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। সেই দলে ছিলেন সম্পূর্ণ মন্ত্রিপরিষদ, কর্মকর্তারা, সৈনিক, কবি, ব্যবসায়ী, উটচালক এবং ১২ হাজার দাস-দাসী। একই সঙ্গে খাবারের জন্য ছিল ছাগল এবং ভেড়ার এক বিশাল বহর। আকাশ থেকে দেখলে মনে হতো, মরুর বুক দিয়ে যেন একটি শহর চলছিল।

এসব সেবকের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল একটি করে সোনার বার। এছাড়া ৮০-১০০টি উট ছিল বহরে, যেগুলো প্রত্যেকটি প্রায় ১৪০ কেজি করে সোনা বহন করছিল। যাত্রাপথে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেন তিনি।

বলা হয়ে থাকে, ওই হজে মুসা আজকের দিনের প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড ওজনের সোনা ব্যয় করেছিলেন। যে কারণে এর পরের কয়েক বছর কায়রো, মক্কা এবং মদিনায় সোনার দাম একেবারেই নেমে গিয়েছিল। এতে অবশ্য শহরগুলোর অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বেড়ে গিয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি।

কায়রোতে মুসার ভ্রমণ সেখানকার বাসিন্দাদের মনে দাগ কেটে যায়। তিন মাস সেখানে অবস্থান করে মানুষকে এতোটাই স্বর্ণ দান করেন মুসা, পরবর্তী ১০ বছর ওই অঞ্চলে স্বর্ণের দাম তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়, অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্টঅ্যাসেট ডটকমের এক হিসাবে, মানসা মুসার মক্কা যাত্রার ফলে স্বর্ণের যে অবমূল্যায়ন হয়, তাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তৎকালীন সময়ে ১৫০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল।

ফেরার পথে আবারো মিশর পার হন মানসা মুসা। অনেকের মতে, যে সময় দেশটির অর্থনীতিকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন তিনি। চড়া সুদে তিনি বেশকিছু স্বর্ণ ধার করে সেগুলো তিনি বাজার থেকে তুলে নেন। আবার অনেকে বলেন, তিনি এত বেশি খরচ করেন যে তার স্বর্ণ শেষ হয়ে যায়।

মানসা মুসা তার তীর্থযাত্রায় যে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ খরচ অথবা নষ্ট করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার এই অতি দানশীলতাই তাকে বিশ্বের নজরে এনে দেয়।মক্কায় হজ পালনকালেই মুসা খবর পান, তার জেনারেল সাগমান্দিয়া গাও শহর দখল করেছে। বিজয়ের পর শহরটি সফর করতে যান তিনি। মালির টিম্বাকটু শহরকে বৃত্তিপ্রাপ্ত মুসলিমদের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেন এই সম্রাট। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন টিম্বাকটু দেখতে আসা শুরু করেন। উনিশ শতকেও টিম্বাকটু ছিল কিংবদন্তির হারিয়ে যাওয়া এক স্বর্ণের শহর।

একইসঙ্গে শহরটি হয়ে ওঠে বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রও। ভেনিস, গ্রানাডা এবং জেনোয়ার মতো ইউরোপীয় শহরগুলোতে যখন এই বাণিজ্য কেন্দ্রটির সংবাদ পৌঁছায় তখন সেখানকার ব্যবসায়ীরা দ্রুত এটিকে তাদের বাণিজ্যিক শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

শিল্প এবং স্থাপনায় উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেন, স্কুল, লাইব্রেরি এবং মসজিদ তৈরিতে অর্থ দান করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই টিম্বাকটু হয়ে ওঠে শিক্ষার কেন্দ্র এবং সারাবিশ্ব থেকে মানুষজন সেখানে পড়তে আসা শুরু করে, যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় সাংকোর বিশ্ববিদ্যালয় নামে।

১৩৩৭ সালে ৫৭ বছর বয়সে মানসা মুসার মৃত্যু হয়। টানা ২৫ বছর মালি শাসন করেন তিনি। যদিও তার ছেলেরা আর সেই সাম্রাজ্য ধরে রাখতে পারেনি। ছোট রাজ্যগুলো একে একে বেরিয়ে যেতে থাকে এবং একসময় পুরো সাম্রাজ্য ধসে পড়ে।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন