অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে জমে যায় হাঁটু পানি। গত এক দশক ধরে এ নিয়ে জনদুর্ভোগের সীমা নেই। তবে দুই সিটি করপোরেশনের গৃহীত কিছু উদ্যোগ এবারের মৌসুমে ভোগান্তি কমাবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও দুই মেয়র। জুনের প্রথম সপ্তাহের ভারী বর্ষণে সেই দাবির সুফল অনেকটাই দেখতে পেয়েছেন রাজধানীবাসী।
হিসাব বলছে, বিগত বছরগুলোতে ৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি হলেই ডুবে যেত রাজধানী। এ বছরও গত ১ জুন ও ৫ জুনের বৃষ্টিতে ভিন্ন বার্তা পাওয়া গেছে। এবার মৌসুমের শুরুতেই ২৪ ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা গেছে।সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসা থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর দুই সিটির নিজস্ব অর্থায়নেই খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। এ কাজে দুই সিটির প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। খালগুলো থেকে প্রায় কয়েক লাখ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে ‘বহুলাংশে’ মুক্তি দেবে বলে আশ্বস্ত করে। গত ১ জুন ও ৫ জুনের বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে তার আভাস মিললেও সরেজমিনে দেখা গেছে, নিম্নাঞ্চলে এখনও সংস্থা দুটির দেওয়া প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
দুই সিটি করপোরেশনের জলবদ্ধপ্রবণ শতাধিক এলাকা হলো— আশকোনা, আর্মি স্টেডিয়াম এলাকা, বনানী, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি, উত্তরা ১ ও ৪ নম্বর সেক্টর, নয়াটোলা শহীদ আবদুল ওয়াহাব রোড, উত্তর বেগুনবাড়ি, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পূর্ব মনিপুর, দক্ষিণ মনিপুর, আমতলা, পিরেরবাগ, মিরপুর ১০, মিরপুর ১৩, মধুবাগ প্রধান সড়ক, কাওরান বাজার টিসিবি ভবন, তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২, পশ্চিম নাখালপাড়া, পাগলারপুল, পূর্ব রাজাবাজার, পশ্চিম রাজাবাজার, তেজতুরী বাজারের গার্ডেন রোড, গ্রিন রোড, ধানমন্ডি ২৭, পশ্চিম ধানমন্ডি ঈদগাহ রোড, নিউমার্কেট সাইকেল স্ট্যান্ড, ইস্কাটন রোড, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, নাজিমউদ্দিন রোড, গণকটুলী সিটি, নবাবগঞ্জ পার্ক, ঝিগাতলা কাঁচাবাজার, বংশাল ২৮ কে পি ঘোষ স্ট্রিট, কসাইটুলী, আগা সাদেক রোড, আগামসী লেন, আব্দুল হাদি লেন, বাংলাদেশ মাঠ, মাজেদ সরদার রোড, সিক্কাটুলী, কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরা বাজার, সিদ্দিক বাজার, আলু বাজার, আওলাদ হোসেন লেন, নব রায় লেন, মিয়াজান গলি, মাদ্রাসা গলি, ঋষি পাড়া, কে এম দাস লেন সংলগ্ন রাস্তা, আরকে মিশন রোড ও অভয় দাস লেন, গোপীবাগ বাজার রোড, ধলপুর স্টাফ কোয়ার্টার।
গত কয়েক বছরে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা ছিল জলাবদ্ধতার মূল কেন্দ্র। কিন্তু এবার বর্ষায় তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে। আশপাশের কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হলেও শান্তিনগরে তেমনটা হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানায়— বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাঁটুপানির সৃষ্টি হতো। দীর্ঘ সময় ধরে এই পানি সরতো না৷ এ অবস্থায় বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ সিটি। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা প্রায় ৮০ ভাগ কমে গেছে।
জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলো নিয়ে শঙ্কা থাকলেও ৫ জুনের ভারী বর্ষণের কিছুক্ষণ পরই মিরপুর ১০, সাংবাদিক কলোনি, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পূর্ব মনিপুর, দক্ষিণ মনিপুর, ধানমন্ডি ২৭ এলাকা থেকে আধাঘণ্টার কম সময়ে পানি নেমে যেতে দেখা যায়। যদিও অপেক্ষাকৃত নিচু আবাসিক এলাকাগুলোতে পানি তুলনামূলক বেশি সময় ধরে জমে ছিল।
পানি জমলেও জলাবদ্ধতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতেও এসব এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা ছিল। এই সমস্যা নিরসনে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট পরিকল্পনা বস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন। যদিও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলাকাভিত্তিক নয়, বরং সমন্বিত ও দীর্ঘ মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই এই ‘অভিশাপ’ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া যাবে।
তারা বলছেন, রাজধানীজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর চলমান কাজের কারণে একটা বড় এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা সহসাই দূর করা সম্ভব না। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানি প্রবাহের বিভিন্ন ড্রেন ও নালা ভরাট হয়ে গেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে বিমানবন্দরের সামনে থেকে বনানী ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত পানি নিষ্কাশনের নালা অকার্যকর হয়ে আছে। এছাড়া মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাই-৬ এর বিভিন্ন স্থানে ড্রেনেজ লাইন কাটা পড়েছে। এ কারণগুলো জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাল ও বক্স কালভার্টগুলোতে দৃশ্যমান পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। একইসঙ্গে সেসব খালের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলে থাকা জায়গা পুনরুদ্ধার করেছি। এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১০ লাখ টনের বেশি পলি ও বর্জ্য অপসারণ করেছি। আমাদের সার্বিক কার্যক্রমের কারণে এই বর্ষায় ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে বহুলাংশে মুক্তি দিতে পেরেছি।’
উত্তর সিটি এলাকায় গত বছরের চেয়ে কম জলাবদ্ধতা হওয়ার বিষয়ে ওয়াসা থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশিরভাগ খাল পরিষ্কার করাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। নিজেদের অর্থায়নে বিভিন্ন স্থানে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার করা হয়েছে বলে এবার সুফল পেতে শুরু করেছে রাজধানীবাসী।’