চুল কেন পড়ে, আধুনিক চিকিৎসা

অনেক রোগী চিকিৎসকের কাছে চুল পড়া সমস্যা নিয়ে আসেন। এছাড়াও চুল পেকে যাওয়া, চুলের আগা, গোড়া কিংবা মাঝে ফেটে বা ভেঙে যাওয়া সমস্যা নিয়েও অনেক রোগী মনোকষ্টে ভোগেন।

চুল পড়ার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন আল-রাজি হাসপাতালের ত্বক, চুল ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দিদারুল আহসান।

চুল পড়ার কারণ

পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে চুল পড়ার কারণ ভিন্ন ভিন্ন। পুরুষদের চুল পড়ার প্রধান কারণ বংশগত। একে এন্ড্রোজেনিক এলোপেসিয়া বলে। এছাড়া পুষ্টিগত সমস্যাতেও চুল পড়ে। বর্তমান সময়ে অনেকেই জাঙ্ক ফুট বা ফাস্ট ফুড এবং ফরটিফাইড ফুড খেতে অভ্যস্ত। এর ফলে পুষ্টিহীনতায় চুল পড়তে পারে। পক্ষান্তরে সুষম খাবার, যেমন শাক-সবজি, ফল, আমিষ আমরা কম খাই। এ থেকেও চুল পড়ে। আমরা সুস্বাদু খাবার খেতে চাই কিন্তু সুষম খাবার খাই না। শারীরিক পরিশ্রমের অভাব চুল পড়ার অন্যতম কারণ। বসে বসে কাজ করা বা সিডেন্টারি লাইফস্টাইল চুল পড়াকে ত্বরান্বিত করে। এদের ব্রেন ওয়ার্ক বেশি হয় কিন্তু দেহের মুভমেন্ট কম হয়। আর একটি কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা। হেয়ার জেল, কালার, ড্রায়ার ব্যবহার থেকেও চুল পড়ে। যাদের খুশকির সমস্যা আছে তাদের চুল পড়তে দেখা যায়।

মহিলাদের চুল পড়ার অন্যতম কারণ অপুষ্টি। গ্রামের মহিলারা অল্প খাবার খায় তাই অপুষ্টিতে ভোগে। শহরের মেয়েরা ক্রাশডায়েট করে ফলে চুল পড়তে থাকে।

খুশকি

ত্বকের মৃত কোষ যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় এবং স্বাভাবিক নিয়মে পড়ে যায় না, তখন খুশকি বা ত্বকের আঁশ বা চালের গুঁড়ার আকারে স্কাল্প বা মাথায় জমা হয়। এটিই খুশকি। শীতকালে স্বাভাবিক নিয়মে খুশকি হয়, কারণ বাতাসে পানি কম থাকে। ফলে ত্বক ও চুল শুষ্ক হয়ে যায়। এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শে ময়েশ্চারাইজার বা তেল লাগানো যেতে পারে। অনেক সময় ধরে গোসল করলে কিংবা ৫-৭ দিন ধরে গোসল না করলে, অনেক বেশি সাবান বা শ্যাম্পু ব্যবহার থেকেও খুশকি হতে পারে।

খুশকি ত্বকের কিছু সিরিয়াস রোগের কারণেও হতে পারে। এর মধ্যে সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা সোরিয়াসিস প্রধান। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কিটোকোনাজল শ্যাম্পু সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করা যায়। রোগীকে জানতে হবে, এ খুশকি তার অতিরিক্ত চুল ধোয়া কিংবা মাথার তালু পরিষ্কার না করা, বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকার কারণে নাকি কোন রোগের কারণে হচ্ছে। কারণ বুঝে চিকিৎসা নিতে হবে। যাদের মাথার ত্বক তৈলাক্ত, আঁচড় দিলে নখে ময়লা জমে তাদেরও খুশকি হতে পারে। তবে এ খুশকি সাধারণত হতে দেখা যায় না। এ রোগীরা খুশকি হয়েছে বলে বুঝতেও পারে না।

শুষ্ক ত্বকে খুশকি বেশি হয়, এ রোগীদের নিয়মিত তেল ও চিকিৎসকের পরামর্শে এন্টিড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হয়। শ্যাম্পু হচ্ছে এক ধরনের ক্লিনজার, যখন মাথার ত্বকে অতিরিক্ত তেল বা ময়লা জমে তখনই শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হয়। এটি স্কাল্পের তেল পরিষ্কার করে। মাথায় খুশকি বেশি হলে শ্যাম্পু প্রতিদিন একবার করে, কম হলে একদিন পরপর আরও কম হলে সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করা যায়।

খুশকি ভালো না হওয়ার অন্যতম কারণ, শ্যাম্পু পর্যাপ্ত সময় মাথায় ব্যবহার না করা। অবশ্যই তিন মিনিট ধরে শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। তেল চুলকে বাইরে থেকে সুরক্ষা দেয়। জেল জাতীয় কেমিক্যাল চুলে ব্যবহার করা ঠিক নয়। এতে চুল ভেঙে যায় ও চুলের রং ম্যাট করে দেয়।

চুল পেকে গেলে

চুল পেকে যাওয়ার অন্যতম কারণ অপুষ্টি ও পরিবেশ দূষণ। বর্তমানে সুপার এন্টি অক্সিডেন্ট চুল পাকা চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। চুলের কালার বা কেমিক্যাল শখ করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। এটি চুল ভেঙে ফেলে ও চুলের গোড়া নষ্ট করে দেয়। বেশি বয়সে চুল পাকলে কসমেটিক কারণে হেয়ার কালার ব্যবহার করতে পারেন। তবে এ কালার ব্যবহারে চুলের ত্বকে কারও কারও অ্যাকজিমা হয়। এ রকম হলে এ রোগীদের হেয়ার কালার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার কারও কারও চুলের গ্রোথের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এ ড্রায়ারে দুটি মোড আছে। একটি হিট মোড যা কখনও ব্যবহার করা ঠিক নয়, অন্যটি হচ্ছে কুল মোড যা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বের হয়, সপ্তাহে ১-২ বার ব্যবহার করা যায়।

চুল পড়ার আধুনিক চিকিৎসা

প্রথমে বের করতে হবে চুল কেন পড়ছে। এটি কী বংশগত নাকি অ্যালার্জিজনিত, অপুষ্টি নাকি চুল পরিচর্যার ভুল টেকনিক অবলম্বন করার জন্য। পিআরপি অর্থাৎ প্লাটিলেট রিচড প্লাজমা চুল গজানোর আধুনিক চিকিৎসা। আমাদের রক্তে তিন ধরনের কণিকা আছে। এর মধ্যে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট আমাদের দেহের ক্ষয় পূরণ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পিআরপিতে রোগীর দেহ থেকে রক্ত নিয়ে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের সাহায্যে এই তিন ধরনের কণিকা পৃথক করা হয়। ডায়াবেটিসে ব্যবহৃত ইনসুলিন সিরিঞ্জের সাহায্যে এ প্লাটিলেট চুল পড়ে যাওয়ার স্থানে ইনজেকশন আকারে দেয়া হয়। এটি বিশ্বব্যাপী কার্যকরী ও আধুনিক চিকিৎসা। আমাদের মাথায় প্রায় এক লাখ চুল আছে। প্রতিদিন ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। এর চেয়ে বেশি পড়লে তা অস্বাভাবিক। কীভাবে বুঝবেন আপনার চুল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পড়ছে। দুই আঙ্গুল দিয়ে ৪০ থেকে ৬০টি চুল ধরে হাল্কা টান দিলে যদি ৫ থেকে ৭টি চুল উঠে আসে তাহলে বোঝা যায় আপনার চুল পড়ার হার বেশি। এক ধরনের ক্যামেরা চুলের গোড়ায় বসিয়ে মনিটর দিয়ে দেখা হয় চুল পড়ার হার স্বাভাবিক কী না। পিআরপি থেরাপি সাধারণত ৬টি সেশন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ১২টি সেশন করলে চুলগুলো স্টাবেল হয়। খরচ হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশনের তুলনায় কম। এটি শতভাগ নিরাপদ। ১২ সেশনের পরও ৫-১০ ভাগ রোগীর মেইনটেনেন্স থেরাপি হিসেবে বছরে ১ থেকে ২ বার পিআরপি আবার করা যেতে পারে। চিকিৎসা যদি যথাযথভাবে করা যায় তাহলে পিআরপি করলে সাফল্য আসে। এতে চুলের গ্রোথ বুস্টআপ করা হয়। এর সঙ্গে মুখে খাওয়া ও লাগানোর ওষুধও ব্যবহার করতে হয়। যদি এতেও কাজ না হয় তবে হেয়ার ট্রান্সপ্লানটেশন করা হয়। রোগীর শরীর থেকেই ১-২ মিলিমিটার চুল নিয়ে যেখানে চুল নেই সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই চুল রোগীর সারা জীবনই থাকে। পড়ে যায় না। পূর্ণ ফলাফল পেতে ৬-১৮ মাস সময় লাগে।

চুল পড়া নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। চুল পড়া শুরু হলে প্রাথমিক অবস্থাতেই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে চুল পড়ার কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা মঙ্গলজনক।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন