ঘ্যাচ!
তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আচমকা ব্রেক কষায় তন্দ্রাভাব ছুটে গেল। সোজা হয়ে বসার পর ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলাম-
: কী হইল! বেরেক মারলেন ক্যান?
সিএনজি অটোরিকশার চালক আমার কথার জবাব না দিয়ে পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করল। ড্রাইভারের কারবার দেখে অভিভূত হলাম। হায়, হায়! এতদিন মন্ত্রী বাহাদুরের কথা অবিশ্বাস করে না জানি কত গুনাহ করেছি! দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ে তার কথাবার্তা যে গুলবাজি নয়, এর বড় প্রমাণ চোখের সামনে সিএনজি অটোরিকশা চালকের বেনসন-সুধা পান। মনে মনে একুশবার আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করলাম। যে দেশে একজন অটোরিকশা চালকের পকেটে দেশের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট থাকে, সে দেশের মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা ঘোরতর অন্যায়। নাদান বলেই এতদিন আমি মন্ত্রীর কথা মগজে ধারণ করতে পারিনি। আল্লাহর দরবারে তওবা-আস্তাকফিরুল্লাহ পেশ করার পর ড্রাইভারকে আবারও বললাম-
: ভাই! গাড়ি কী জন্য থামাইলেন, বললেন না?
লোকটা তবুও নির্বিকার। আমি পুনরায় মুখ খুলতেই তাচ্ছিল্যভরে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলল-
: রাস্তা বন্ধ।
: রাস্তা কে বন্ধ করছে?
: সামনে চাইয়া দেখেন; সাইনবোর্ডে লেখা আছে।
ঘাড় নিচু করে সামনের দিকে তাকাতেই মাটির উপরে ঠ্যাঙ্গা ফিট করা আড়াই ফুট উচ্চতার একটা সাইনবোর্ড নজরে এলো। তাতে বাংলায় লেখা-উন্নয়ন কাজ চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত…
উন্নয়ন সংঘটনকারী কর্তৃপক্ষ তিন ফুট বাই আড়াই ফুট একটা ‘রূপভান’ টিনের ওপর তুলির আঁচড় কাটার মধ্য দিয়ে দুঃখ অবমুক্ত করেছে; কিন্তু আমার দুঃখ রাখার জায়গা কোথায়? নির্ঝঞ্ঝাট অবস্থায় থাকলে দুঃখটাকে বাতাসে অবমুক্ত করে গন্তব্যে পাড়ি জমানো যেত। সঙ্গে মালপত্র আছে। এগুলো নিয়ে হেঁটে রাস্তা পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। সিগারেটে সুখটান দিয়ে উচ্ছিষ্টটুকু পাশের নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে বিরক্তি ভরা কণ্ঠে ড্রাইভার বলল-
: আর কতক্ষণ বসাইয়া রাখবেন? ভাড়া দিয়া আমারে বিদায় করেন।
: বিদায় করব মানে? বস্তা লইয়া আমি কোথায় যাব?
: কোথায় যাবেন, সেইটা আপনের ব্যাপার। ক্যাচাল না কইরা আমার ভাড়া দেন; আমি বিদায় হই।
: আমি তোমার হাতে-পায়ে শিকল দিয়া রাখছি নাকি? ক্ষুদিরামের মতো বিদায় দেন, বিদায় দেন বইলা গান ধরছ কেন? সারাদিন পাবলিকের পকেট কাটার ধান্ধা কইরা বেড়াও বুঝলাম; কিন্তু মানুষ বিপদে পড়লে সেইটা দেখবা না? বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ-এইসব কি সিএনজির চাক্কার লগে বাইন্ধা রাখছ?
কথা শুনে ড্রাইভার রাগে গজগজ করতে লাগল। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে বাড়ি থেকে ফেরার সময় বড় একটা বস্তায় চাল-ডাল, আনাজপাতি, কলা, নারকেল ইত্যাদি দুনিয়ার জিনিস ভরেছি। বস্তা নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে রাজধানীর মহাখালী পর্যন্ত আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুরু হয়েছে বাস থেকে নামার পর। সরকার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ কত সব চমৎকার কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে; অথচ গণপরিবহণে সামান্য নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজটা কেন করতে পারছে না, বোধগম্য নয়। অনেক তোয়াজ-তদবির শেষে সিএনজি অটোরিকশার এই চালক মহানুভবতার পরিচয় দিলেও শেষ পর্যন্ত এখানে এসে উন্নয়নের গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছি। এই গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে, বুঝতে পারছি না। প্রবল চায়ের তৃঞ্চা অনুভব করছি। একটু দূরে একটা চায়ের দোকান দেখে অটোরিকশা থেকে নামলাম। চা পান শেষ করে পা বাড়াতেই দেখি-দুজন পুলিশ ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে। পুলিশ দেখে আমার পুলকিত হওয়া উচিত। কিন্তু পুলকিত হওয়া যাচ্ছে না। এরা ইউরোপ-আমেরিকার পুলিশ নয়, মানুষের মুশকিল আসান করার জন্য জান কোরবান করে দিবে। এদেশের পুলিশ হচ্ছে মহাত্যাদড় টাইপের। কারও এক পা গর্তে পড়ার পর অন্য পা-টাও কীভাবে গর্তে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়-এরা সারাক্ষণ সেই ফন্দি-ফিকির করে। কাছে যেতেই একজন পুলিশ জিজ্ঞেস করল-
: গাড়ির মধ্যে কী আছে?
: লাগেজ।
: সিএনজির রুট পারমিট তো লাগেজ পরিবহণের জন্য দেওয়া হয় নাই।
: কিসের জন্য দেওয়া হইছে?
: মানুষ নেওয়ার জন্য।
: আপনাদের চাকরিও তো দেওয়া হইছে মানুষের জানমাল রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেইটা কি রক্ষা হইতেছে?
: লেকচার তো ভালোই শিখছেন। এই ড্রাইভার, থানায় চল।
: থানায় যাবে কী জন্য?
: গাড়ির মধ্যে অবৈধ মালামাল আছে। থানায় যাওয়ার পর তল্লাশি হবে।
: বেশ তো! চলেন, থানায় চলেন।
আমার কথা শুনে পুলিশ দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারা ভেবেছিল, থানায় যাওয়ার কথা শুনে আমি হাতের তালু ঘষতে থাকব। তাদেরকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বললাম-
: ভাই! ড্রাইভারের কাছ থেইকা যে প্যাকেট পাইছেন, তার মধ্যে কয়টা সিগারেট আছে?
: গুইনা দেখি নাই।
: গুনেন।
সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখা গেল, এর মধ্যে ১০টা সিগারেট আছে। ড্রাইভারের ত্যান্দামি দেখে মেজাজ অত্যধিক খারাপ হয়েছে, তাই আর্থিক ক্ষতি কবুল করে বললাম-
: আমি পুরা এক প্যাকেট বেনসনের দাম দিতেছি। আপনারা আপনাদের টহলদারি অন্যদিকে সম্প্রসারিত করেন।
পুলিশ দুজন চলে যাওয়ার পর ড্রাইভারকে বললাম-
: এই অকামটা কী জন্য করতে গেলা? সেরের ওপরে সোয়া সের পাইলে বাংলাদেশের পুলিশ যে আগের পার্টির কথা ভুইলা যায়, এই কথা কি তোমার জানা নাই! নেও, এইবার গাড়ি স্টার্ট দিয়া ঘুইরা অন্যপথে চল। অসুবিধা নাই; ভাড়া বাড়াইয়া দিব।
ড্রাইভার বিরস মুখে ইঞ্জিন চালু করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। বারকয়েক চেষ্টা করার পর চেহারায় নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তুলে আমার দিকে তাকাতেই জানতে চাইলাম-
: সমস্যা কী?
: ইঞ্জিনে ট্রাবল দিতেছে।
: তুমি আবার ‘তার-মার’ ছিইড়া রাখছ না তো?
: বিশ্বাস করেন স্যার, এইটা ইঞ্জিনের ট্রাবল।
: ইঞ্জিন ট্রাবল দেওয়ার আর সময় পাইল না? বাইছা বাইছা ঠিক এই সময়েই ট্রাবল দিল?
: বাইচান্সের কি লাইসেন্স আছে? যে কোনো সময় ট্রাবল হইতে পারে।
: এখন উপায়?
: একটা রিকশা ঠিক কইরা সামনের মেইন রোডে গেলেই গাড়ি পাইয়া যাবেন।
: তুমি কী করবা?
: দেখি আশেপাশে কোনো গ্যারেজ আছে কিনা? ঠেলাধাক্কা দিয়া গ্যারেজ পর্যন্ত যাই। কপালে দুঃখ থাকলে করার কিছু নাই।
রিকশার তালাশে বের হলাম। এটা ভিআইপি রোড। কাজেই এ রাস্তায় কোনো রিকশা থাকার কথা নয়। হাঁটতে হাঁটতে একটা গলির মধ্যে ঢুকে কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে পটানোর চেষ্টা করলাম। ভিআইপি রোডের অজুহাত দেখিয়ে কেউ রাজি হচ্ছে না। শেষে একজন রিকশাওয়ালাকে ধমকের সুরে বললাম-
: তুমি আস। কোনো অসুবিধা নাই।
: ট্রাফিকে আটকাইয়া দিবে।
: ট্রাফিক পুলিশের বিষ নামানোর ওষুধ আমার জানা আছে। এইটা হইল দশ টাকার মামলা। দশ টাকা দিলেই আসামি খালাস।
তারপরও রিকশাওয়ালা দুনোমুনো করতে থাকে। কাতরস্বরে অনুনয় করে তাকে বললাম-
: আরে ভাই, চল তো! বস্তা লইয়া বিপদে পড়ছি।
রিকশা নিয়ে অকুস্থলে ফেরার পর চোখ কপালে ওঠে গেল। যতদূর চোখ যায়, তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম; কিন্তু কোথাও সিএনজি অটোরিকশা ও চালকের দেখা মিলল না। আমি বোকাসোকা মানুষ; কিন্তু এতটা বোকা নই-এই সরল সমীকরণটা বুঝতে পারব না। রিকশাওয়ালাকে ‘সরি’ বলে ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুটপাতের অবস্থা এমন করে রাখা হয়েছে, এর ওপর দিয়ে হাঁটা কোনোমতেই সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। সঙ্গে বস্তা না থাকায় এখন আর হাঁটতে কোনো বাধা নেই। জমা হওয়া দুঃখগুলো সযতনে বুক পকেটে রাখার পর সামনে পা বাড়ালাম…