নৌযান বা তীরের কোনো স্থাপনা বা ভাসমান স্থাপনা থেকে নদীতে বর্জ্য ফেললে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইন, ২০২১’ এর খসড়া করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে খসড়া আইনটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ (অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬)’-কে যুগোপযোগী করে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনের খসড়া করা হয়েছে। এ আইনে অনেক নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বিধান লঙ্ঘনের শাস্তিও বাড়ছে। একই সঙ্গে নৌ-চলাচল সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থাগুলোর কাজের আওতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এখন শুধু যে নৌযান থেকে দূষণকারী বর্জ্য নদীতে ফেলা হয় তা নয়, নদীর তীরের বিভিন্ন স্থাপনাও নদী দূষণ ঘটাচ্ছে। নৌযানের সংখ্যা তো দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষ শুধু প্রয়োজনেই নৌযান ব্যবহার করছে না, বিনোদনেও নৌযানের ব্যবহার বাড়ছে। নৌযানের তেল-মবিল পানিতে মিশছে, নৌযান থেকে প্লাস্টিক নদীতে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। পয়ঃবর্জ্য সরাসরি নৌযান থেকে নদীর পানিতে মিশছে। এগুলো নদীর দূষণ ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আশা করি আইনটি দ্রুত চূড়ান্ত হবে
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনের খসড়া আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছি। ওখানে একটি কমিটি আছে, সেই কমিটি যাচাই-বাছাই করবে। আইনটি প্রণয়নে আপাতত আমাদের পর্যায়ের কাজ শেষ। ওই কমিটি দেখবে, তাদের যদি কোনো অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) থাকে তা জানাবে, আমরা সে অনুযায়ী পরিমার্জন করবো খসড়াটি। এরপর খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।’
সাজা হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা রেখেই খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘এখন আরও অনেক ধাপ অতিক্রম করবে, সেখানে শাস্তির বিষয়গুলো তারা দেখবেন, কোনো বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো দেখে তারা এটি চূড়ান্ত করবেন।’
তিনি বলেন, ‘আগের অধ্যাদেশটি ভারাক্রান্ত ছিল, যেগুলো আইনের মধ্যে না রেখে বিধিমালায় নেয়া দরকার। আগে আইনটি ইউজার-ফ্রেন্ডলি ছিল না। আইনের কিছু কিছু জিনিস আমরা বিধিমালায় নিয়ে যাবো।’
‘কিছু বিষয় ছিল, বিআইডব্লিউটিএসহ অন্যান্য দপ্তর-সংস্থার কাজের নির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। কিছু অস্বচ্ছতা ছিল, ডুপ্লিকেশন বা ওভারল্যাপিং ছিল। নতুন আইনে সেগুলো দূর করে সবার কাজগুলো ওয়েল ডিফাইন থাকবে।’
শুধু শাস্তির বিধান করলেই হবে না। পাশাপাশি নৌযানের বর্জ্য যেন নির্ধারিত স্থান থেকে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নৌযানের বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে তার ডিসপোজ করারও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে, সেটা সরকারকে করতে হবে
সচিব আরও বলেন, ‘আগে বিধিমালা ছিল না। আইনটি চূড়ান্ত হলে আমরা আইনের অধীনে বিধিমালার কাজে হাত দেবো।’
নতুন আইনে নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌ-সীমানায় কোনো নৌযান থেকে বা তীরসংলগ্ন কোনো স্থাপনা বা ভাসমান স্থাপনা থেকে তেল অথবা তৈলাক্ত পদার্থ, অপরিশোধিত পয়ঃমল, দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও কিচেন গার্বেজ, যে কোনো ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ বা বস্তু, যে কোনো ধরনের টক্সিক পদার্থ, জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর যে কোনো বস্তু, পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ ও রং নষ্টকারী কোনো পদার্থ নদীতে নির্গত বা নিক্ষেপ করা যাবে না।
এ বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। জানমাল রক্ষার প্রয়োজনে ও নৌযান উদ্ধারের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ, এটা আরও আগে করা প্রয়োজন ছিল। এখন শুধু যে নৌযান থেকে দূষণকারী বর্জ্য নদীতে ফেলা হয় তা নয়, নদীর তীরের বিভিন্ন স্থাপনাও নদী দূষণ ঘটাচ্ছে। নৌযানের সংখ্যা তো দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষ শুধু প্রয়োজনেই নৌযান ব্যবহার করছে না, বিনোদনেও নৌযানের ব্যবহার বাড়ছে। নৌযানের তেল-মবিল পানিতে মিশছে, নৌযান থেকে প্লাস্টিক নদীতে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। পয়ঃবর্জ্য সরাসরি নৌযান থেকে নদীর পানিতে মিশছে। এগুলো নদীর দূষণ ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আশা করি আইনটি দ্রুত চূড়ান্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু শাস্তির বিধান করলেই হবে না। পাশাপাশি নৌযানের বর্জ্য যেন নির্ধারিত স্থান থেকে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নৌযানের বর্জ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে তার ডিসপোজ করারও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে, সেটা সরকারকে করতে হবে।’শিল্পকারখানার বর্জ্য বিষাক্ত করে ফেলছে আশপাশের নদীগুলো
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, খসড়া আইনে নৌযান জরিপের জন্য জরিপ স্টেশন স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, কোন নৌযানের নকশা কে অনুমোদন করবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। নৌযান নির্মাণ, পরিবর্তন, পুনর্নির্মাণ বা রূপান্তরে প্যানেল সুপারভাইজারদের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে খসড়ায়।
এছাড়া আমদানি করা নৌযানের রেজিস্ট্রেশনে বিল অব এন্ট্রি ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তি দাখিল, ৪০ বছরের পুরোনো নৌযান বাতিল (ফেইজ আউট), প্রোটোকল চুক্তির নৌযান চলাচলের জন্য সনদ স্বীকৃতি, মাস্টার ড্রাইভারদের যোগ্যতা সনদ পাঁচ বছর অন্তর নবায়ন, নাবিকদের কর্মঘণ্টা প্রশিক্ষণ মহাপরিচালকের নির্ধারণ, সব অভ্যন্তরীণ নৌযানের নাবিকদের নিবন্ধন, নৌ দুর্ঘটনার তদন্ত নিরপেক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা সম্পন্ন করা, ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত পুলিশের করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে খসড়া আইনে।
নৌপথের ওপর দিয়ে ক্যাবল অতিক্রম বা ব্রিজ নির্মাণ করার আগে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নেয়া ও নৌযানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ও প্রস্তাবিত আইনে যুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে খসড়ায় দূষণ প্রতিরোধে ভারী তেল বহনকারী ট্যাংকারে লাইট তেল বহন করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
নতুন আইনের যে কোনো ধারা লঙ্ঘনের জন্য অপরাধের গুরুত্ব বা মাত্রা ও ব্যাপ্তি বিবেচনা করে সর্বনিম্ন দণ্ড থেকে সর্বোচ্চ দণ্ড পর্যন্ত মোট পাঁচটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা।
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীর এমনই আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশেও সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, তবে জরিমানা সর্বাচ্চ এক লাখ টাকা।
বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঝড়ের সংকেত থাকাবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। খসড়া আইনে এক্ষেত্রে শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যাত্রীবাহী নৌযানের ওপরের ডেকে মালামাল বহন করলে নৌযানটির মালিক তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত এবং মাস্টার তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন। নতুন আইনে শাস্তি বেড়ে হচ্ছে সর্বোচ্চ চার বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ নৌযান বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনো নৌযাত্রায় নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলে মালিক বা তার প্রতিনিধি বা মাস্টারকে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। এক্ষেত্রেও খসড়া আইনে সর্বোচ্চ চার বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।