করোনা ওলটপালট করে দিয়েছে সব কিছু। অতিমারির ঝাপটায় পিছিয়ে পড়েছে সব খাত। তবে সবচেয়ে বেশি গ্যাঁড়াকলে পড়ে শিক্ষা খাত। শিক্ষাঙ্গনের দরজায় দীর্ঘদিনের তালা, শিক্ষার্থীদের লম্বা সময়ের প্রতীক্ষা! অবশেষে বেজেছে স্কুল-কলেজ খোলার ঘণ্টা। আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আজ রবিবার সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশনা আসতে যাচ্ছে।
এই সুসংবাদের সঙ্গে আছে দুঃসংবাদও! করোনাকালে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই আর স্কুলে ফিরবে না। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী এরই মধ্যে বিভিন্ন কাজে জড়িয়েছে। জোর করে অনেক মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা কত হবে তার ধারণা না মিললেও কিন্ডারগার্টেন আর বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরই শিক্ষাঙ্গনমুখী না হওয়ার শঙ্কা বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়া রোধ করাটাই এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তি এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি স্কুলের পথ ভুলতে থাকে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া নতুন নতুন পরিবারও দরিদ্র হয়েছে। ফলে ঝরে পড়ার হার আরো বাড়বে।
গেল জানুয়ারিতে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। তবে করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। গত ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। দরিদ্রতার মুখোমুখি ৫৬ শতাংশ পরিবার দাবি করেছে, করোনার সময় তাদের আয় কমেছে। ধার করে, সঞ্চয় ভেঙে এবং খাদ্য ব্যয় কমিয়ে এই সংকট মোকাবেলা করেছে তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেখানে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারটি মাথায়ই রাখেনি। এসব দরিদ্র পরিবারের অনেক সন্তান শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে, যারা আর স্কুলে না-ও ফিরতে পারে।
গেল জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক তথ্য মেলে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকের ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন, অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বাড়বে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক পরিবারেই দারিদ্র্য বেড়েছে। অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। স্কুল খোলার পর সব শিশুকে ফিরিয়ে আনতে একটা অভিযান চালানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া সরকারের একটা প্রণোদনা দেওয়া দরকার। সেটা হতে পারে মিড ডে মিল বা দুপুরের গরম খাবার। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক্সট্রা ক্লাসেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ যেভাবেই হোক শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে সে ব্যাপারে সরকারকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আমরা বুঝতে পারব, কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল কি না? দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের আমরা উপবৃত্তি দিচ্ছি, যা করোনার সময়ও চলমান আছে। সেখানে একটা শর্তই আছে, নিয়মিত স্কুলে আসতে হবে। তাই স্কুল খোলার পর কোনো শিক্ষার্থী না এলে আমরা সহজেই বের করতে পারব। এ ছাড়া প্রত্যেক স্কুল থেকেই তার সব শিক্ষার্থীকে ক্লোজ মনিটরিং করা হবে। নিয়মিত এসংক্রান্ত রিপোর্ট আমাদের পাঠাতে হবে। ফলে আমরা ঝরে পড়ার কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারব।’
তবে ঝরে পড়ার উদাহরণ রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের সরকারি তথ্যেও। প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হিসাব করেই প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যের বই ছাপানো হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ পাঠ্য বই ছেপে বিতরণ করেছে। তবে আগামী শিক্ষাবর্ষে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৩১৩ কপি বই ছাপার লক্ষ্য র্নির্ধারণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেই হিসাবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্য বই কমছে ৭৭ লাখের বেশি।
সূত্র জানায়, সাধারণত প্রতিবছরই শিক্ষার্থী বাড়ে। শিক্ষার্থী বাড়ার কারণে বছরে গড়ে প্রায় আড়াই শতাংশ পাঠ্য বই বাড়ে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এবার শিক্ষার্থী বেড়েছে—এমন তথ্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে নেই। তারা এখনো শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে পারেনি।
গেল মার্চে প্রকাশিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে গত বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার ৫০.৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে। ৪৭.৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সে। আর ১.৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৭.৯ শতাংশ ছেলে-মেয়ে দেশে প্রচলিত বিয়ের বয়স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তবে ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দারিদ্র্য এবং কঠিন জীবন ধারণের কারণে তাঁরা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
বাল্যবিয়ের ফলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম উদাহরণ যশোরের মণিরামপুরের পাড়িয়ালি বালিকা মাদরাসা। করোনা সংক্রমণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে এই মাদরাসাটিও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় আট মাস পর যখন অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার জন্য মাদরাসা খোলা হয়, তখন জানা যায় এ সময় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ২০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তবে এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দেড় বছর পার হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, এরই মধ্যে করোনাকালে দেশে বাল্যবিয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
গেল বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়েতে বিশ্বে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। দেশে বাল্যবিয়েতে শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। জেলার মধ্যে শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সবচেয়ে কম বাল্যবিয়ে ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে।
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই যুক্ত হয়েছে শিশুশ্রমে। এর অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। পরিবারের আয় বাড়ানোর তাগিদে স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কাজে লাগিয়েছেন অভিভাবকরা। আর এই দরিদ্রতাও যেহেতু সহজেই দূর হওয়ার ব্যাপার না, তাই স্কুল-কলেজ খুললেও এসব শিক্ষার্থী আর ক্লাসে ফিরবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
করোনাকালে রাজধানীতে যত্রতত্র শিশুশ্রমিকের দেখা মেলে। বিশেষ করে বিভিন্ন কারখানা, ওয়ার্কশপ, মুদি দোকান, হোটেল, পরিবহনে শিশুরা কাজ করছে। ইব্রাহিমপুরের একটি মুদি দোকানে গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে কাজে যোগ দিয়েছে মিশু। সে জানায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল সে। তার বাবা তাকে কাজের জন্য পরিচিত একজনের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন সে নিজে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি বাড়িতেও টাকা পাঠায়।
করোনাকালে কিন্ডারগার্টেন ও নন-এমপিও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রয়েছে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায়। গত দেড় বছরে বেশির ভাগ স্কুলেরই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এসব স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী নানা কাজে যুক্ত হয়েছে, অনেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে এই স্কুলগুলোর অনেক শিক্ষার্থীই আর ক্লাসে ফিরবে না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘করোনার মধ্যেও আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিছুটা বেড়েছে। তবে সমস্যা হতে পারে বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনে। তবে কোনো শিক্ষার্থী যাতে ঝরে না পড়ে সে জন্য আমরা সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমাদের উপবৃত্তি ও মিড ডে মিল চালু আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দরিদ্র পরিবারও যাতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সাপোর্ট পায় সে ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকরা সহায়তা করবেন।’