তালেবান শেষবার যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, তখন সেখানে আফিম চাষে রীতিমতো বান ডেকেছিল। তাদের ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান গঠনের তিন বছর পর ১৯৯৯ সালে দেশটির মোট আফিম উৎপাদন দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টনে, যা এর আগের বছরগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এর প্রায় সিকি শতাব্দী পর আজও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আফিম উৎপাদনকারী রয়ে গেছে আফগানিস্তান। কিন্তু চলতি মাসের শুরুতে তালেবান কাবুল দখলের পর ঘোষণা দিয়েছে, তারা দেশটিতে আর আফিম উৎপাদন বা মাদক বিস্তারের অনুমতি দেবে না।
তবে কাজটি খুব একটা সহজ হবে না বলে মনে করছে প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। জাতিসংঘের তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে পত্রিকাটি জানায়, গত বছর বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে, তার ৮৫ শতাংশই ছিল আফগানিস্তানে। এদিক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী মিয়ানমার-মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। এমনকি সারাবিশ্বে গাঁজা ও মেথামফেটামাইন সরবরাহেও আফগানিস্তান বড় ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, কঠোর ইসলামী নীতির অনুসারী হলেও আফিম চাষের সঙ্গে তালেবানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে তারা মুসলিমদের জন্য সিগারেট নিষিদ্ধ করলেও আফিম চাষের অনুমতি ঠিকই দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালে আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করে তালেবান সরকার। তবে ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলোতে ফের আফিম চাষ বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল নয় হাজার টনে।
কিন্তু আজ তালেবানের সামনে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা আর কোনো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী নয়, তাদের এখন আর বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে না। পশ্চিমাসমর্থিত সরকারকে হটিয়ে তালেবান আজ আফগানিস্তানের একচ্ছত্র শাসক। এখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানের ভাগ্যবদল নির্ভর করছে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর হাতে।
বদঅভ্যাস
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৮শ শতাব্দীতে আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এর পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে ১৯৭৯ সালের পর, যখন দেশটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। জাতিসংঘের হিসাবে, ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে বৈশ্বিক আফিম উৎপাদনের ৫৯ শতাংশ আসত আফগানিস্তান থেকে। তবে তালেবান আমলে এর পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যার কারণে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সংগঠনটিকে।
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ওমর ২০০০ সালের জুলাই মাসে আফিম চাষ ও ব্যবসা নিষিদ্ধ করেন এবং এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী তহবিল থেকে ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদান পেয়েছিলেন। পরের বছর জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওই নীতিতে সাফল্যের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এর পরেই মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের মুখে ভেস্তে যায় সব। আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো একের পর এক এলাকায় বাড়তে থাকে আফিম চাষ। ২০০৪ সালে এটি প্রথম তালেবানি আমলের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এবং শিগগিরই তা দ্বিগুণ আকার ধারণ করে। এরপর সেখানে আফিম চাষ ঠেকাতে আর কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসেনি।
ত্যাগ করা কঠিন
আফিম বাণিজ্য তালেবানের পুনরুত্থানে কতটা ভূমিকা রেখেছে তা বলা কঠিন। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, আফিম বাণিজ্য থেকে তহবিল সংগ্রহ, সেইসঙ্গে তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অতিরঞ্জিত। যেহেতু এসব মাদকের বেশিরভাগ অংশ বিদেশে রপ্তানি হয়েছে, তাই আফগানিস্তানের বাইরের অপরাধী চক্রগুলোই সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, আফিম উৎপাদনকারী প্রদেশ নিমরুজে মাদকের চেয়ে ট্রানজিট পণ্য, জ্বালানির মতো বৈধ খাতগুলোতে কর আরোপ করেই অনেক বেশি অর্থ আয় করেছে তালেবান। ২০২০ সালে ট্রানজিট কর থেকে ৪ কোটি ৯ লাখ ডলার ও জ্বালানি কর থেকে ৫১ লাখ ডলার আয় করেছে গোষ্ঠীটি। অথচ ২০১৮ সালে আফিম বাণিজ্যের কর থেকে তাদের আয় ছিল মাত্র ৩ কোটি ৯৯ লাখ ডলার।
গত ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখলের পরপরই আফগান সরকারের বেশ কিছু তহবিল আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতারও আশ্বাস পায়নি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। ফলে অর্থ সংকট কাটাতে সবধরনের উৎসের দিকেই হাত বাড়াতে হতে পারে নতুন আফগান প্রশাসনকে। তবে আফিম উৎপাদন বন্ধের ঘোষণায় ইরান-রাশিয়ার মতো প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেতে পারে তালেবান। হাত বাড়াতে পারে মাদকপাচারের অন্যতম গন্তব্য ইউরোপ-কানাডাও।
তাছাড়া নিজস্ব উৎপাদিত আফিমে ক্ষতির শিকার হচ্ছে আফগান সমাজ। ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশটিতে মাদকসেবীর সংখ্যা ২৯ লাখ থেকে ৩৬ লাখের মতো। এই সমস্যা মোকাবিলায় পশ্চিমাসমর্থিত আফগান সরকার যেমন হিমশিম খেয়েছে, সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে তালেবানও।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ রবার্ট ক্রুস বলেন, অনেক সম্প্রদায়ের কাছে টিকে থাকার জন্য আফিম চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খরা ও করোনাভাইরাসের কারণে আফগান চাষিরা এমনিতেই চরম অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন। ফলে আফিম চাষ বন্ধের সিদ্ধান্তে তারা বিরোধিতা করতে পারেন।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের স্কলার হারুন রাহিমি বলেন, তালেবান কঠোর। তারা বলপ্রয়োগ করতে পারে। তবে ঠিক কতটুকু বলপ্রয়োগ করা যাবে তার সীমা রয়েছে। এটি অনেকটা তাদের প্রধান সমর্থক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহারের মতো হবে।