যুগে যুগে অলিম্পিকে নারীর পোশাকে বিপ্লবের সুর

করোনার কবলে নাজেহাল বিশ্ব। এরই মধ্যে টোকিওতে শেষ হলো অলিম্পিক গেমস। তবে এবারের অলিম্পিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ওই বাক্যের মতো। ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। নানা বিষয় এখনো রয়েছে আলোচনায়। এবারের আসরের ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্যের পাশাপাশি বিশেষ আলোচনায় ছিল নারী ক্রীড়াবিদদের পোশাক।

বর্তমানে নারী ক্রীড়াবিদরা কেবল অলিম্পিকেই নয় বরং যেকোনো ক্রীড়াক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করছে। তবে শুরুতে নারীদের এ আসরে যোগ দেওয়ায় বাধা ছিল। আধুনিক অলিম্পিক গেমস শুরু হয় ১৮৯৬ সালে। তখন নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। ১৯০০ সালে ইতিহাসে প্রথম নারী ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার অনুমতি পায়। যদিও সে সময় ভাবা হতো মেয়েরা খেলাধুলা করলে তাঁদের মধ্যে পুরুষালী ভাব দেখা দেবে। তাই নারী ক্রীড়াবিদদের তথাকথিত নারীসুলভ কমনীয়তা বজায় রাখতে আজানুলম্বিত স্কার্ট আর গাউন পরে খেলতে বাধ্য করা হতো।

একেবারে প্রথম দিকে অলিম্পিকে পরিপূর্ণ গাউন পরা নারী তিরন্দাজরা, লম্বা স্কার্ট পরা টেনিস খেলোয়াড়েরা তাক লাগানোর মতো ভালো খেলেছেন। ভালো খেলে আলোচনায় এসেছেন। তবে পোশাকের কারণে তাঁদের যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছিল। সে বছরই ব্রিটিশ টেনিস খেলোয়াড় শার্লট কুপার গোঁড়ালি–ছোঁয়া গাউন পরে দারুণ খেলে জিতে নেন শিরোপা। ১৯২৬ সালের অলিম্পিকে ফরাসী নারী টেনিস খেলোয়াড় সুজান লেংগ্লেন প্রথম হাঁটু পর্যন্ত প্লিট দেওয়া আরামদায়ক স্কার্ট পরে চ্যাম্পিয়ন হন। এরপরে ধীরে ধীরে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর সরব শক্তিশালী উপস্থিতিতে এসব পোশাকের বাধাবিপত্তি তুচ্ছ হয়ে যেতে থাকে।

কালের বিবর্তনে সংক্ষিপ্ত ইউনিফর্মে তেমন বাধা না থাকলেও বাধে আরেক বিপত্তি। নারী অ্যাথলেটদের পোশাকে অতি আবেদনময়তা আর নারীকে নিছক প্রদর্শন আর ‘ভোগবিলাসের বস্তু’ হিসেবে উপস্থাপনের চাপ থাকে। এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে নারী ক্রীড়াবিদদের পক্ষ থেকে। বিচ ভলিবলের মতো উথালপাতাল কসরতের খেলায় যেখানে পুরুষেরা আরামদায়ক শর্টস পরছেন, সেখানে রীতিমতো নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করে নারী খেলোয়াড়দের জন্য বিকিনি বটম পরার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে। তবে এই টোকিও অলিম্পিক গেমসের আগে আগেই ইউরোপীয় বিচ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে নরওয়ের নারী খেলোয়াড়েরা এই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শর্টস পরেই খেলেছেন। ফলে জরিমানা গুনতে বাধ্য হয়েছেন। এতে করে সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সংগীত তারকা পিংক তো জরিমানার অর্থ নিজে পরিশোধ করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত পোশাকের (যেমন জিমন্যাস্টিক্সে লিওটার্ড) কারণে নারী ক্রীড়াবিদদের দিকে বেশির ভাগ সময়ে ক্যামেরা তাক করা থাকত। এতে করে তাঁদের মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয়। এ জন্যই জার্মান নারী জিমন্যাস্টরা শরীর ঢাকা ইউনিটার্ড কস্টিউম পরে এবার অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। আর তাঁরা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। জার্মান জিমন্যাস্ট সারাহ ভসের মতে, জিমন্যাস্টিক্সের মতো কষ্টসাধ্য আর ক্রীড়ানৈপুণ্যের স্পোর্টসকে আবেদনময়, প্রদর্শনমূলক রূপ দেওয়ার বিরুদ্ধেই তাঁদের এই প্রতিবাদ।

মুদ্রার অপর পিঠে আবার উইলিয়ামস বোনরা অনেক সময় ইচ্ছেমতো কস্টিউম পরতে গিয়ে বহু ঝামেলায় পড়েছেন। সেরেনা উইলিয়ামসের ক্যাটস্যুটকে রীতিমতো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুবারের প্যারাঅলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন অলিভিয়া ব্রিনকে আবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে লং জাম্প ইভেন্টে শুনতে হয়েছে যে তাঁর শর্টস বেশি ছোট, যা নিয়ে হয়েছে তুমুল প্রতিবাদ আর বিতর্ক। হকি, আইস হকিসহ অনেক খেলায় নারী খেলোয়াড়দের ফেমিনিন, নজরকাড়া, আকর্ষণীয় লুক দিতে অযথা স্কার্ট পরার নিয়ম করে দেওয়া আছে। যেখানে এর চেয়ে স্পোর্টস শর্টস বা টাইস পরে খেলা অনেক সুবিধাজনক।

সদ্য শেষ টোকিও অলিম্পিকে নারী অ্যাথলেটরা তাঁদের রুচি ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পোশাক পরেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা বিপ্লবী ও শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নারী হোক বা পুরুষ, ক্রীড়াবিদের পরিচয় তাঁর কৃতিত্বে, ক্রীড়া নৈপুণ্যে। এটাই এবারের অলিম্পিকের নারী অ্যাথলেটদের কস্টিউম বাছাইয়ের মূলমন্ত্র ছিল। তাই তো এবারের অলিম্পিক এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছে, যাতে নারী অ্যাথলেটদের জন্য বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়। প্রায় সব দেশের স্কেট বোর্ড কস্টিউম খেলার জন্য আরামদায়ক কি না, সেদিকে খেয়াল রেখেই বানানো হয়েছে।

অলিম্পিক ব্যাডমিন্টনে নারীরা শর্টস, স্কার্ট, স্কর্ট (শর্টসের মত স্কার্ট), ড্রেস এবং পুরো ঢাকা পোশাকের সঙ্গে হিজাবও খুব স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে পরেছেন। টোকিও অলিম্পিকের আয়োজকেরা খুব সচেতনতার সাথেই ক্রীড়াঙ্গনে লিঙ্গবৈষম্য মোকাবিলা করতে উদার ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, কোনো সন্দেহ নেই, নারী ক্রীড়াবিদরা সহজাত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আরও ভালো ফল অর্জন করতে পারবেন।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন