তিন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য

মডেল পিয়াসা ও চিত্রনায়িকা পরীমনির গ্রেফতারের ঘটনায় অন্তত তিনজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশ কয়েকজন ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।

এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ‘ম’ আদ্যাক্ষরের একজন প্রভাবশালী ব্যাংকারের সংশ্লিষ্টতা এবং তার বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর পরের ধাপে রয়েছে জনৈক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম এবং ফ্যাশন হাউজ ভাসাভির কর্ণধার জামান মোল্লা ওরফে নুরুদ্দিন। এছাড়া আরও কয়েকজন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চিত্রনায়িকা পরীমনিকে গ্রেফতারের বিষয়ে ৪ মাস আগেই অজ্ঞাত একটি ফোন নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপস থেকে খুদে বার্তাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠানো হয়। তথ্যটি আসে শোবিজ জগতের বিশিষ্ট নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীরে ফোনে। পরে তিনি স্পর্শকাতর তথ্যটি পরীমনির ফোনে ফরোয়ার্ড করেন। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এদিকে এ মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি প্রসঙ্গে সিআইডি প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন- পরীমনি ও পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেকের নাম আসছে। যাদের মধ্যে কয়েকজনকে চিঠি দিয়ে ডাকা হচ্ছে। এদের কেউ কেউ এ মামলার সাক্ষী হতে পারেন। তবে যাদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে না, তাদের আতঙ্কের কিছু নেই। সূত্র বলছে, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং চিত্রনায়িকা পরীমনির গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘ম’ আদ্যাক্ষরের জনৈক প্রভাবশালী ব্যাংকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং পরবর্তী সময়ে তাকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কারণে গ্রেফতার হন পিয়াসা ও তার সহযোগী মৌ। কিন্তু পরে নায়িকা পরীমনির আকস্মিক গ্রেফতারে পুরো গোলক ধাঁধায় আটকে যায়। অনেকে বিষয়টিকে শোবিজের শুদ্ধি অভিযান বলে ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মুখোশ অতিক্রম করে যার অনেক কিছুই ধীরে ধীরে সামনে চলে আসতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিত্রনায়িকা পরীমনি গ্রেফতারের নেপথ্যে রয়েছে তার বিশৃঙ্খল জীবন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সাবেক এক লাক্স তারকার সঙ্গেও তার বিরোধ তুঙ্গে। তবে পরীমনির অভিযোগের সূত্র ধরে বোট ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ গ্রেফতার হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। প্রথমদিকে এ ‘লু হাওয়া’ পরীমনির অনুকূলে থাকলেও তা অনেকটা নাটকীয়ভাবে বৈরী হয়ে উল্টোদিকে ধাবিত হয়।

সূত্র বলছে, পরীমনির সঙ্গে প্রভাবশালী অনেকের ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তার কারণেই অনেকের দাম্পত্য জীবনে এখন ভাঙনের সুর। এসব নিয়ে অন্তত দুজন প্রভাবশালীর স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ মহলে অভিযোগ করেন। এছাড়া জামিনে মুক্ত হয়ে নাসির উদ্দিনও বোট ক্লাবে ঘটে যাওয়া সেই রাতের প্রকৃত ঘটনাচিত্র সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে তুলে ধরেন।

এভাবেই পরীমনিকে গ্রেফতারের প্লট তৈরি হয়ে যায়। যদিও অনেকের কাছে দৃশ্যত মনে হতে পারে, বোট ক্লাবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরীমনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সূত্রমতে, তাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তটি অনেক আগের। নানা কারণে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছিল। তবে বোট ক্লাবের ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার ব্যবস্থা করে।

সূত্র জানায়, ৮ এপ্রিল নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর কাছে একটি অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ৭-৮টি এসএমএস আসে। এতে বলা হয়, ‘পরীমনির সামনে অনেক বড় বিপদ। তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে মিটিং হয়েছে।’ এ ধরনের এসএমএস পেয়ে পরীমনির খুব কাছের মানুষ হিসাবে চয়নিকা চৌধুরী বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পরীমনিকে জানান। এছাড়া পরীমনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন তাকে সার্বক্ষণিক কারা যেন বিভিন্নভাবে অনুসরণ করছে। আগাম তথ্য জানতে পেরে পরীমনি নড়েচড়ে বসেন। গ্রেফতার এড়াতে দেনদরবার শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের মোবাইল ফোন বন্ধ করে চালু করেন নতুন নম্বর। তিনি পরিচিতজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ সীমিত করে দেন। কিন্তু তার শেষরক্ষা হয়নি।

সূত্র বলছে, পরীর বিষয়ে সাবধান করে খুদে বার্তা পাঠানো মোবাইল নম্বরটি ঘিরে তদন্ত চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি পুলিশকে সংশ্লিষ্ট মোবাইল নম্বর এবং এসএমএসগুলো দিয়েছেন। নম্বরটি রবি কোম্পানির। জনৈক হালিমা আক্তারের নামে নিবন্ধিত। জাতীয় পরিচয়পত্রে হালিমার মায়ের নাম ফাতেমা। বাবা হাবিজ মিয়া এবং স্বামীর নাম আক্তার হোসেন। পেশা গৃহিণী। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার পশ্চিম পিপইয়াকান্দি গ্রামে তার বাড়ি। গোয়েন্দাদের ধারণা, নম্বরটি হয়তো ভুয়া এনআইডি দিয়ে নিবন্ধিত। অথবা ব্যবহারকারী সংশ্লিষ্ট কারও বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। এসএমএসদাতা নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে গৃহকর্মীর নম্বর ব্যবহার করেন। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য ফোন করা হলে নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

পিয়াসা গ্রেফতারের নেপথ্যে : সূত্র বলছে, বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মৌ গ্রেফতার হন মূলত ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগে। ‘ম’ আদ্যাক্ষরের এক প্রভাবশালী ব্যাংকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। একপর্যায়ে ওই ব্যাংকারের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মেরে দেন পিয়াসা। টাকা চাইলে নারীঘটিত বিষয় প্রকাশের ভয় দেখানো হয়। এছাড়া গুলশানের ভাসাভি ফ্যাশন হাউজের মালিক জামানের সঙ্গেও পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তার কারণে জামানের সংসারে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। একপর্যায়ে জামানের স্ত্রী তানজিয়া চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পিয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। এরই সূত্র ধরে পহেলা আগস্ট সহযোগী মৌ নামের এক সহযোগীসহ গ্রেফতার হন পিয়াসা। গ্রেফতারের সময় বারিধারার বাসায় পিয়াসা সাংবাদিকদের বলেন, তার গ্রেফতারের পেছনে জামানের স্ত্রীর হাত রয়েছে। মূলত জামানের পরকীয়া সম্পর্কের কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কে এই জামান : জামানের পুরো নাম জামান মোল্লা ওরফে নুরুদ্দিন। তার বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে। চার ভাইয়ের মধ্যে তার এক ভাই লতিফ মোল্লা আওয়ামী লীগ নেতা এবং বর্তমানে শিবচর উপজেলা চেয়ারম্যান। এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পরে রাজনীতি ছেড়ে জাপান চলে যান। প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফেরার পর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায় নাম লেখান। ব্যবসা সূত্রে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ভারতীয় তারকাদের ঢাকায় এনে কনসার্ট আয়োজন করেন। কিন্তু ইভেন্ট ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হয় তার। এরমধ্যে ২০০৭ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। এক-এগারোর আমলে অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেন। তার দাপটে প্রতিষ্ঠিত অনেক রাজনীতিবিদকে দেশছাড়া হতে হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে মাদারীপুর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এমপি নির্বাচন করলেও তিনি পরাজিত হন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। এছাড়া পিয়াসার ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম নেপথ্যে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি। গুলশানে তার মালিকানাধীন ভাসাভি নামের অভিজাত ফ্যাশন হাউজ রাজধানীর অন্যতম দামি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত।

সূত্র বলছে, পিয়াসা ও পরীমনির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জাবির খান নামের এক ব্যক্তির নাম পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গুলশানের পার্টি জগতের পরিচিতমুখ জাবির খান মাদক ও পর্নো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েক বছর আগে তিনি থাইল্যান্ডে মাদকসহ গ্রেফতার হন। পরে অন্তত ৮ কোটি টাকা খরচ করে জামিন পান। তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন