জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র জাহিদ হাসান। পড়ছিলেন রসায়ন বিভাগে। এরই মধ্যে তার নামের পাশে বসেছে অনেকগুলো বিশেষণ। বোমা জাহিদ, কাতারপ্রবাসী ফোরকান, রাজু বা ফোরকান ভাই নামেও তার পরিচিতি। সবচেয়ে বড় পরিচিতি এখন নব্য জেএমবির বোমা তৈরির অন্যতম কারিগর হিসেবে।
অনলাইনে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপস ব্যবহার করে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় নব্য জেএমবির সদস্যরা। বোমাগুলো ছিল একই প্যাটার্নের। যারা বোমগুলো বানায় তাদের বিভিন্ন সময় অভিযানে গ্রেফতার করা হলেও নতুন করে আবার মেলে একই প্যাটার্নের বোমার খোঁজ। তদন্তে নামে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
পুলিশের জঙ্গি প্রতিরোধে বিশেষায়িত সিটিটিসির তদন্তে উঠে আসে নব্য জেএমবির সদস্য জাহিদের নাম। তিনিই অনলাইনে বোমা বানানো শেখান। জাহিদ এখনও পলাতক। তবে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন তার দুই সহযোগী শফিকুর রহমান হৃদয় ওরফে বাইতুল্লাহ মেহসুদ ওরফে ক্যাপ্টেন খাত্তাব ও মো. খালিদ হাসান ভূঁইয়া ওরফে আফনান।
সিসিটিসির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নিষ্ক্রিয় হয় দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো। এর ঠিক তিন বছর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পুলিশ বক্সে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস ব্যবহার করে হামলা ও হামলাচেষ্টার মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা।
সম্প্রতি মিরপুর থেকে সাব্বির ওরফে বামসি বারেক ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আরেক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বোমা মিজান-পরবর্তী দক্ষ কারিগরের ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য পান গোয়েন্দারা। সবশেষ গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর থেকে শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়।
সাইনবোর্ডে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা রাখার অভিযোগে গত রোববার (১১ জুলাই) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে নব্য জেএমবির সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলারকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এছাড়া ১১ জুলাই রাতে কেরানীগঞ্জ থেকে নব্য জেএমবির আরেক সদস্য কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামা গ্রেফতার হন।
গ্রেফতার এই দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে নব্য জেএমবির বোমা তৈরির এক কারিগর জাহিদের নাম পাওয়া যায়। হলি আর্টিসান হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার এক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এর আগে জাহিদের বিষয়ে প্রথম তথ্য পায় সিটিটিসি। তারপর থেকেই তাকে শনাক্তের চেষ্টা চলছিল। সবশেষ ওসামা ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পায় সিটিটিসি।
একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
সিটিটিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, জাহিদের জন্ম ১৯৯৪ সালের ১২ অক্টোবর। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা। লেমুয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে পাথরঘাটা সৈয়দ ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। স্নাতক সম্পন্ন করলেও মাস্টার্স সম্পন্ন করেননি।
এক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ডার্ক সাইটে উগ্র মতাদর্শভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন জাহিদ। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়ানোর ব্যাপারে দাওয়াত পান। একপর্যায়ে জঙ্গিবাদে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। পরে জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যেসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন, সেখানে সক্রিয় সদস্য হন। ধীরে ধীরে জাহিদ অনলাইনে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপস ব্যবহার করে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ চৌধুরী সুমন জাগো নিউজকে বলেন, গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা করে নব্য জেএমবির সদস্যরা। বোমাগুলো ছিল একই প্যাটার্নের। বিভিন্ন অভিযানে একাধিক জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হলেও বোমা তৈরির কাজ থামেনি। নতুন করে ফের একই প্যাটার্নের বোমার খোঁজ মিলতে থাকে।
‘তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, বোমা বানানোর জন্য নব্য জেএমবির আলাদা সেল রয়েছে। আগে তাদের আস্তানায় বোমা তৈরি করলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে বর্তমানে তারা অনলাইনে বোমা তৈরির কাজ করে। জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে অনলাইন সেল খোলেন জাহিদ।’
তিনি বলেন, অনলাইনে বোমা বানানোর সেলগুলোকে বলা হয় ইদাদ সেল। এমন তিনটি ইদাদ সেল রয়েছে জাহিদের নেতৃত্বে। প্রতিটি ইদাদ সেলে ২০-২২ জন করে সদস্য জাহিদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে অনলাইনের মাধ্যমে। তিন অনলাইন সেলে প্রায় ৫০-৬০ জন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেন। তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
বোমা জাহিদের খোঁজ সম্পর্কে এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী সুমন বলেন, রসায়ন পড়া ছাত্র ছাড়া এ ধরনের একই প্যাটার্নে বোমা তৈরির কাজ অন্য কেউ করতে পারে না। পুলিশ বক্সে বোমা হামলাকারীদের বেশিরভাগই গ্রেফতার হয়। তবে বোমা তৈরির মূল কারিগরকে খুঁজতে থাকে সিটিটিসি। তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো কেউ এই বোমাগুলো বানাচ্ছে। তখন সন্ধান মেলে জাহিদের। তবে জাহিদ এখনও পলাতক। তাকে গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে সিটিটিসি।
অনলাইনে বোমা বানানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এভাবে বোমা তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণ কিংবা দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারে বলেও জানান সিটিটিসির এই কর্মকর্তা।
সিটিটিসির প্রধান পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জাহিদ একজন বড় মাপের নব্য জেএমবির সদস্য। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। বোমা তৈরির মূল কারিগরকে খুঁজতে গিয়ে তার তথ্য পাওয়া যায়। তাকে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। তাকে গ্রেফতারে অনলাইন ও অফলাইনেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
উগ্রপন্থীদের যেকোনো তৎপরতা রুখতে সিটিটিসি নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে জানান তিনি।