করোনায় বাড়ছে বাল্যবিয়ে

ক্রমেই বাড়ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা। টানা প্রায় দেড় বছর থেকে করোনার মহামারী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে এসব অপরিণত বয়সের বিয়ের ঘটনা ঘটছে। দারিদ্র পীড়িত এ জনপদে কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবেই এখনো দেখেন অভিভাবকরা।পাশাপাশি কন্যা শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা,দারিদ্র্যতার কষাঘাত আর কুসংস্কারের কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।

কুড়িগ্রামে কর্মরত এনজিও আরডিআরএস এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার তপন কুমার সাহা জানান, প্লান ইন্টার ন্যাশনালের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় আমরা বিডিএফজি (বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গালস্) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্যে বাল্য বিয়ের হার কমিয়ে আনা। এ প্রকল্পের অধীনে মাঠ পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত নিয়ে প্রতি মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এর নাম ম্যারেজ ট্রাকিং রিপোর্ট।

এ রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী-২০১৮সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১সালের জুন পর্যন্ত জেলায় ২১হাজার ১০০টি বিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা-১৭ হাজার ৯৮৪টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা-৩ হাজার ১১১টি।

জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ২ হাজার ৯৫৩টি। এই সময়ে সামাজিক ও প্রশাসনের উদ্যোগে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে এক হাজার ১২০টি। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ৭০২টি, রাজারহাটে ৭৩টি, উলিপুর ২৫৯টি, চিলমারীতে ১৪০টি, রৌমারীতে ৮৪টি, রাজিবপুরে ৪৯টি, নাগেশ্বরীতে ১ হাজার ১২৮টি, ফুলবাড়িতে ২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে ২২৭টি বাল্য বিয়ে সংগঠিত হয়েছে। যদিও করোনার লকডাউন চলাকালে জরিপের কার্যক্রম কিছুটা স্থবিরতা হয়ে পড়েছে। ফলে জেলার বাল্যবিয়ে হার বাস্তবতার আলোকে আরও অনেক বেশি বলে আশংকা করা হচ্ছে।

জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহনাজ পারভীন বলেন, করোনার কারণে এ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কাজ নেই বলেই চলে। ফলে মাঠ পর্যায়ের সঠিক কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। একইভাবে এনজিও গুলোও তাদের কাজের পরিধি কমিয়ে নেয়ায় বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত সঠিক কোনো তথ্য মিলছে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা বাগবান্ধা গ্রামে রাতের রান্নাবান্না করছে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ১৪ বছরের কিশোরী রূপালী খাতুন। মাটির চুলোয় খড়ির আগুনে কড়াইতে মাছের টুকরা ভাজতে দেখা যায় রূপালীকে।

যে হাতে থাকবার কথা বই-কলম-খাতা। এখন সেই হাতে সংসারের হাড়ি-পাতিল-খন্তি। যে বয়সে দুরন্তপনা করার কথা সেখানে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। স্বামী মঞ্জু মিয়া রৌমারী-ঢাকা বাসের হেলপার। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে দেয় রূপালীর পরিবার।

দিনমজুর হেলাল উদ্দিন-ফুলবানু দম্পতির মেঝ কন্যা রূপালী। করোনার প্রভাবে একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে হাতে কাজ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রূপালীর বিয়ে দেন বাবা-মা। তুলনামূলক এই চরাঞ্চল গুলোতে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে থেকে বেশি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং করোনার প্রভাবে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় রূপালীর মতো রাজিবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুরি আক্তার ২৪ ডিসেম্বর বিয়ে হয়। রুপালী, মমতাজ, ফাতেমা, নুরিসহ বহু মেয়ে বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে গত দেড় বছরেই।

বাল্যবিয়ের দৃশ্য জেলার চরাঞ্চলগুলোতে হরহামেশাই ঘটছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর ছোট-বড় প্রায় ৫ শতাধিক চর ও দ্বীপচর। এসব চরাঞ্চলে প্রাইমারী কিংবা উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। প্রত্যন্ত এসব চরাঞ্চল গুলোতে ধর্মীয় চিন্তা, কুসংস্কার ছাড়াও অভাব,দারিদ্র্যতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দেন অভিভাবকেরা।

এছাড়া রয়েছে আরও অনেক কারণ। এর মধ্যে কন্যা শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা, মেয়ের বয়স বাড়লে বাড়ে যৌতুকের টাকার পরিমাণ বেশি হয়, কম বয়সী মেয়েদের প্রতি বরের চাহিদা বেশি, যৌতুকের পরিমাণও কম লাগে।

বাল্যবিয়ের স্বীকার রূপালী বলেন, আমার বাবা-মায়ের থাকার জমিজমা নেই। অভাবে পড়েই বিয়ে দিয়েছে। স্কুলও বন্ধ। খাবারের সমস্যা। কখন কোন অঘটন ঘটে তাই বিয়ে দিয়েছে।

নুরি আক্তার বলেন, সে রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মা ভালো পরিবার পাইছে তাই বিয়ে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে থাকার কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই বিয়ে দিছে। এমনি ভাবে আমার অনেক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে।

দিনমজুর হেলাল উদ্দিন বলেন, কাজকর্ম নাই। মেয়েকে যত বড় করমো ততই ডিমান্ড (যৌতুক) বাড়বে। তাতে স্কুল বন্ধ। অভাবের মধ্যে খরচ বেশি হয়। সেজন্য মেয়েকে কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছি। যৌতুক ৩০ হাজার টাকার মধ্যে নগদে দিছি ১৫ হাজার টাকা দিয়া বেটি পার করছি।

কোদালকাটি এলাকার মজিবর বলেন,এই চরের মধ্যে বাহে বেটির কোন নিরাপত্তা নাই। আর নেকা পড়া করিয়া কি করবে? করোনার কারণে আগের মতন আর কাম কাইজ নাই। খাওয়াইয়া বেশি। ছোটতে বিয়া দিলে যৌতুক কম নাগে তাই বেটিক বিয়া দিছি। বাড়িত বসে থাকি যদি কোনো কেলেঙ্কারি হয়, তা হলে তো বেটিক আর বিয়ে দেওয়া গেইল না হয়।

একই এলাকার মমতাজের মা মহেলা বেগম বলেন, করোনার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে বিয়ে দিয়েছি। করোনার কারণে পড়া লেখা নাইকা। কাম কাজ নাইকা। বিয়া না দিয়া উপায়ও নাই। চিলমারীতে মমতাজের বিয়া দেছি। স্কুল বন্ধ থাকায় এই গ্রামে অনেকেই তাদের মাইয়ার বিয়া দিয়া দেওছে বাপ-মাও।

স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, চরাঞ্চল এলাকা হওয়ায় এখানে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। পিতা-মাতাকে নিষেধ করলেও তারা গোপনে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে গিয়ে গোপনে বিয়ে দেন। তারা ভুয়া জন্ম সনদ দিয়ে এসব বিয়ে পড়ালেও পরবর্তীতে দেখা যায় মেয়ের অভিভাবকরাই বিপদে পড়েন। যৌতুকের টাকা কিংবা অভাবের কারণে বাল্যবিয়ের বিচ্ছেদ ঘটছে অহরহ। কাজীরা বাল্যবিয়ে পড়ার কারণে বিয়ের আসল কাগজপত্র দেয় না। ফলে আইনি সহযোগিতা থেকেও মেয়ের অভিভাবকরা বঞ্চিত হয়।

রৌমারী যাদুরচর ইউপি চেয়ারম্যান সরবেশ আলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাবার কথা স্বীকার করেন। ছেলে-মেয়েদের বয়স লুকিয়ে অন্য উপজেলা কিংবা অন্য ইউনিয়নে নিয়ে গিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। আবার এমনও ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র হুজুর ডেকে কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এসএম আব্রাহাম লিংকন বলেন, সরকারি তথ্য মতে- দেশে কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। আর করোনা কালে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কুড়িগ্রাম আদালত পাড়ার ৬০-৭০ ভাগ মামলা যৌতুক, স্ত্রী নির্যাতন, দেনমোহরানার বা বিচ্ছেদ সংক্রান্ত। মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায় অধিকাংশই বাল্য বিয়ের কারণে পরবর্তী সংসার জীবনে এ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসিসহ ইউপি চেয়ারম্যানরা সজাগ রয়েছে। তারা যে কোনো সময় বাল্যবিয়ের খবর পেলে তা প্রতিরোধ করে। আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হয়। পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ চলমান। এটি সামাজিক ব্যাধি। বাল্য বিয়ে বন্ধে সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।

Full Video


ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এটা দেখেছেন কি? দেখে নিন