আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।এ সময় বাসা থেকে বিদেশি মদ ও মুদ্রা, হরিণ ও ক্যাঙ্গারুর চামড়া, ওয়াকিটকি সেট এবং ক্যাসিনোর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয় বলে অভিযান শেষে জানান র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।
পরে দিবাগত গভীর রাতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মেয়ে জেসিয়া আলম বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া মদ ও অন্যান্য মালামালের বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।জব্দ করা মালামালের মধ্যে মদের বিষয়ে জেসিয়া আলম বলেন, ‘আমার ভাইয়া মদ খায়, সেগুলোই বাসায় ছিল। ভাইয়ার মদ খাওয়ার লাইসেন্স রয়েছে। ওই লাইসেন্সও উনারা (র্যাব) নিয়ে গেছেন। পাসপোর্টও আছে।’
হরিণের চামড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হেলেনার মেয়ে বলেন, ‘ভাইয়ার বিয়ের সময় মায়ের সঙ্গে রাজনীতি করা নেতা-নেত্রীরা মিলে ওটা গিফট করেছেন। সেটি ওয়ালে ঝুলানো ছিল।’
ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদির বিষয়ে জেসিয়া আলম বলেন, ‘মানুষ গেম খেলতে পারে না? একটি পুরোপুরি ক্যাসিনো করার জন্য মানুষের কী লাগে? টেবিলসহ অন্যান্য অনেক কিছু লাগে। কিন্তু, এখানে শুধু ব্রিফকেস ভরা ক্যাসিনো চিপস। আমরা খেলতে পারি না? এটার মধ্যে টাকা ইনভলভ করাটা কি খুব জরুরি? আমরা নিজেরাই খেলতাম আর সময় কাটাতাম। ধরুন, বাসায় তাস খেলে না কেউ? সে রকম একটা বিষয়।’
বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে জানতে চাইলে জেসিয়া আলম বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বিদেশে যাই। অনেকগুলো দেশে আমাদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। আমাদের কাছে পাসপোর্টও রয়েছে। বিদেশ থেকে আসার পর যে মুদ্রাগুলো থেকে যায়, সেগুলো আমরা রেখে দেব নাকি ফেলে দেব? ওসব মুদ্রা থেকে গেছে।’
র্যাব যা পেয়েছে বলে দাবি করেছে, তার সত্যতা স্বীকার করার বিষয়ে জেসিয়া আলমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের বাসায় ইলিগ্যাল (অবৈধ) জিনিসপত্র ছিল। তাই বলে ওরকমভাবে অভিযান চালিয়ে হ্যারাসমেন্ট করাটা কি ঠিক? এটার কত বড় যে ইমপ্যাক্ট, আপনারা কিন্তু দেখবেন না। হয়তো হেলেনা জাহাঙ্গীর বলছেন, উনি অনেক স্ট্রং, কিছু হবে না। কিন্তু, এটা উনার মেন্টালিটি এবং ফিজিক্যালি ইমপ্যাক্ট করছে। কয়েক মাস আগে তাঁর অপারেশন হয়েছে। আর, এটার মধ্যে যদি এসব করা হয়, তাহলে একটা মানুষের মন-মানসিকতা ঠিক থাকবে না। আমাদের বাসার কক্ষগুলো যেভাবে চেক করা হয়েছে, এটা তো ভালোভাবে চেক করা যেত। আপনাদের কাছে কোনো ওয়ারেন্ট নেই। রুমের জিনিসপত্র তছনছ করে অভিযান চালালেন উনারা। আমি একজন বইপ্রেমী মানুষ। আমার বইগুলো সব এলোমেলো করা হয়েছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে র্যাব অভিযান চালায় গুলশান ২ নম্বরে হোটেল ওয়েস্টিনের পেছনে ৩৬ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বরে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায়। প্রায় চার ঘণ্টা অভিযান চলে। পরে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় আমরা অভিযান চালিয়েছি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও পশু সংরক্ষণ আইন ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা করা হবে।’
এদিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আজ আজ শুক্রবার বলেছেন, ‘র্যাব হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় ও আইপি টিভিতে অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে আমরা বিভিন্ন অবৈধ জিনিসপত্র জব্দ করেছি। এখন আমরা হেলেনা জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি, পর্যালোচনা করছি। আমরা বিকেলে বলতে পারব, তাঁর বিরুদ্ধে কোন কোন আইনের ধারায় মামলা করে তাঁকে থানায় সোপর্দ করব।’
র্যাব সদর দপ্তর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুপুরে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা দেখেছি, তিনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মানহানি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন। এ জাতীয় কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। পাশাপাশি তাঁর টিভি চ্যানেল এবং জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন সংক্রান্ত কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি, যা আমরা পর্যালোচনা করছি। এরপর বিকেলে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাতে পারব।’
হেলেনা জাহাঙ্গীরের পরিবারের দাবি, ‘র্যাব উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিযান চালিয়েছে।’ এ ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কী, এমন প্রশ্নে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘উনারা (পরিবার) সংক্ষুব্ধ, অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু প্রাণীর চামড়া পাওয়া গেছে ওই বাসায়। এর মধ্যে একটি হরিণের চামড়া এবং একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া। ক্যাঙ্গারু বাংলাদেশে নেই এবং বিদেশি প্রাণি। আমরা যদি আইন অনুযায়ী যাই, তাহলে কিন্তু বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও তাঁর নামে মামলা হতে পারে। ক্যাঙ্গারুর যে চামড়া পাওয়া গেছে, এটার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনেও মামলা হতে পারে। ফলে আমরা আইনানুগ প্রক্রিয়াতে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
আইপি টিভি পরিচালনা ও নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পরিচালনা সংক্রান্ত ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক ঝামেলা আছে প্রতিষ্ঠানটির। উনার আইপি টিভি পরিচালনার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (বিটিআরসি) কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা যে অভিযান পরিচালনা করেছি, সেখানে আমরা অনেক ধরনের সরঞ্জামদি পেয়েছি। সেগুলো একটি স্যাটেলাইট টিভির সরঞ্জামাদি। সেক্ষেত্রে বিটিআরসির সহযোগিতায় যেসব মালামাল জব্দ করা যায়, তা করেছি। সেখানে কী মামলা করা যায় টেলিযোগাযোগ আইনে, সেটাও প্রক্রিয়াধীন।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা পেয়েছি, সেটার অঙ্ক পর্যালোচনা করছি। এটা মানিলন্ডারিংয়ের আওতায় পড়ে কিনা তাও পর্যালোচনা করছি। পর্যালোচনা শেষে যদি মনে হয়, এটা মানিলন্ডারিংয়ের আওতায় পড়ে, তাহলে এ সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা করা হবে।’
‘আমরা সারা রাতই অভিযান চালিয়েছি। বিস্তারিতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ হয়নি। আমরা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। এরপর তাঁর সম্পদ বা ফ্যাক্টরির বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শেষে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে’, যোগ করেন খন্দকার আল মঈন।
এর আগে গত রোববার আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য সচিব মেহের আফরোজ চুমকি স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ হতে তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।’
জানা যায়, নানা বিষয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠন করেন। এতে নিজেকে সভাপতি এবং মাহবুব মনিরকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। এই সংগঠনে জেলা-উপজেলা ও বিদেশ শাখায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টার প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনার পর ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
সংগঠনটির দাবি, গত দুই-তিন বছর ধরেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংগঠনটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
গত সোমবার হেলেনা জাহাঙ্গীর নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে ফেসবুক লাইভে এসে একপর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “পুরুষেরা এত খারাপ কেন? সব পুরুষ নয়, কিছু কিছু কাপুরুষ, এত খারাপ। মেয়েদের পেছনে লেগে থাকে, লজ্জা করে না আপনাদের মেয়েদের পেছনে লেগে থাকতে। মেয়েরা না মায়ের জাতি? মা না থাকলে আপনারা জন্ম হতেন না। সেই মেয়েদের আপনারা অপমান করেন, লেলিয়ে দেন—‘হেলেনা জাহাঙ্গীরের পেছনে লাগো’।”
হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি সরকারের জন্য একটা চ্যানেল চালাচ্ছি। সেটা জয়যাত্রা টেলিভিশন। সেই চ্যানেল আমি ভতুর্কি দিয়ে চালাচ্ছি প্রায় চার বছর যাবৎ। আমি চ্যানেলের বাইরে কোনো কাজ করতে পারি না, এত মনোযোগ দিতে হয় আমাকে।