এবার শতভাগ দেশীয় গরুতে হবে কোরবানি। আজ থেকে টানা ছয় দিন দেশজুড়ে বসবে কোরবানির পশুর হাট। কোরবানির জন্য দেশে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ পশু বিক্রির অপেক্ষায়। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত অনলাইনে ১ লাখ ৮৪ হাজার গরু বিক্রি হয়েছে। এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
অনলাইন প্ল্যাটফরমে এরই মধ্যে ১২ লাখ ৮৪ হাজার পশু কেনার জন্য আবেদন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার পশু বিক্রি হবে এবারের ঈদুল আজহায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কোরবানির হাটে প্রবেশ করতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কোরবানির পশুর হাটবাজার নিয়ে সম্প্রতি এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ১৮ দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরে তা সরকার নির্দেশনা আকারে জেলা পর্যায়ে বার্তা পাঠায়। তবে কোরবানির পশুর হাট, ক্রয়-বিক্রয় ও ঈদে মানুষের অবাধ চলাফেরা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ঈদুল আজহার পর করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে পারে। জানা যায়, এক সপ্তাহও হাতে সময় না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় খামারিরা।
একদিকে করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি, অন্যদিকে সময় স্বল্পতার কারণে কোরবানির গরু বিক্রি করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও সংশয়ে তারা। খামারিদের আশঙ্কা, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে এবার অনেকেই কোরবানি দেবেন না। হাটবাজারে মানুষও কম যাবে। তাছাড়া দেশে কোরবানির পর্যাপ্ত পশু আছে। সব মিলিয়ে গরুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার শঙ্কা তাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো এবার ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় কোরবানি হবে না। বিশ্বজুড়ে করোনার থাবার বাইরে নয় বাংলাদেশও। বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এখন আর্থিকভাবে সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে।
তারা এবার পশু কোরবানির কথা ভাবতেই পারছেন না। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যারা একাধিক পশু কোরবানি দিতেন, তারাও এবার পশুসংখ্যা কমাবেন। অনেকেই এবার করোনাজনিত কারণে পশুর হাটে যেতে অনাগ্রহী। সব মিলিয়ে এবার পশুর চাহিদা থাকবে কম। সঙ্গত কারণেই এবার সারা দেশে পশুর হাটের সংখ্যা কমেছে। আগ্রহী ইজারাদাররা হাটের ইজারা মূল্যও কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশেই পর্যাপ্ত কোরবানির পশু আছে। বাইরে থেকে গবাদি পশু দেশের ভিতরে আসতে দিচ্ছি না। আমদানির প্রয়োজনও নেই। কারণ, গবাদি পশু উৎপাদনকারীদের অনেক অর্থ ব্যয় হয়।
তারা যদি ন্যায্যমূল্য না পান তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বেকার হয়ে যাবেন অনেক তরুণ উদ্যোক্তাও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আমি সব খামারি ও উৎপাদকদের নিশ্চিত করছি আপনারা ন্যায্যমূল্যে গবাদি পশু বিক্রি করতে পারবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘সীমান্তেও আমরা যোগাযোগ করেছি, যাতে চোরাইপথে বা অন্য কোনো পথে একটা পশুও দেশে প্রবেশ করতে না পারে। আমাদের খামারিদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা অনেক কষ্ট করে খামার তৈরি করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন। তাদের পশু বিক্রি হবে না, বাইরে থেকে আসবে- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আশা করছি, খামারিরা পশুর ন্যায্যমূল্য পাবেন।’
বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউটিউবার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান আজিম বলেন, ‘গেল বছর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে প্রচুর গরু অবিক্রীত ছিল। এবার আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না। কারণ, অনেকে এখন চাকরিহীন, নিম্নবিত্তরাও কর্মহীন। যারা আট-দশটা পশু কোরবানি দিতেন, তারা দুই-তিনটা দেবেন। অনেকেই কোরবানির জন্য বাজেট কমাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ গরুর বদলে খাসি কোরবানি দেবেন।’
এদিকে অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে কিংবা বাজারের বাইরে গরু ক্রয়- বিক্রয় হলে হাসিল আদায় করা যাবে না। এটা আইনানুগভাবে অবৈধ বলে জানিয়ে গতকাল জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘শুধু অনলাইন/ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে বাজার পেরিফেরির বাইরে অথবা খামারির নিকট থেকে ক্রয়কৃত পশু পরিবহনকালে ইজারাদার বা তার নিয়োজিত লোকজন যাতে হাসিল দাবি/আদায় করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলো।’
চাহিদার তুলনায় বেশি পশু : এবার কোরবানির চাহিদার তুলনায় দেশে গরু ও ছাগল বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি করেছেন খামার মালিকরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ গবাদিপশু কোরবানি হলেও এবার বেশি হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে এবার কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য গরু রয়েছে ৫৫ লাখ এবং ছাগল-ভেড়া ও মহিষ রয়েছে ৯৫ লাখ। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ গবাদিপশু কোরবানি করা হয়েছিল। এবার পরিস্থিতির উন্নতি হলে কোরবানির পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে হাটে গরুর কোনো সংকট হবে না বলে জানিয়েছেন খামার মালিকরা।
খামারিদের দুশ্চিন্তা : কোরবানির পশু খামারিদের দুশ্চিন্তা বাড়ছেই। করোনার প্রকোপ এখনো কমেনি, বরং আরও দিন দিন বাড়ছে। কোরবানির পশু পর্যাপ্ত। কিন্তু আর্থিক সংকটে থাকা অনেকেই এবার কোরবানি দেবেন না। এ অবস্থায় মাত্র ছয় দিনের হাটে কোরবানির পশুগুলো বিক্রি হবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের খামারিরা। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার খুকনি গ্রামের ‘এফঅ্যান্ডএফ এগ্রো’ খামারের মালিক ফিরোজ হাসান অনিক। গতকাল তিনি হতাশার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বললেন, ‘সারা বছর গরু লালন-পালন করে কোরবানির ঈদের অপেক্ষায় থাকি।
শতাধিক গরু এবার লালন-পালন করেছিলাম। ইতিমধ্যে ৬০টি গরু বিক্রি করেছি। তবে ন্যায্যমূল্য পাইনি। এখন ৪০টি গরু খামারে আছে, যেগুলোর বাজারমূল্য ৪-৬ লাখ টাকা। করোনার কারণে সবার হাতের পরিস্থিতি খারাপ। সে কারণে এখন চিন্তায় পড়েছি, গরুগুলো যথাযথ দামে বিক্রি করতে পারব কি না?’ জানা যায়, বেলকুচিতেই প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় খামার রয়েছে। অনিকের মতো অনেকেই এমন চিন্তায় পড়েছেন গরু নিয়ে। খামারিদের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও প্রায় অধিকাংশ বাড়িতে গরু লালন-পালন করা হয়ে থাকে। বেলকুচির ধুকুরিয়া বেড়া গ্রামের আবদুল্লাহ দুটি গরু পালন করেছিলেন। লকডাউনের কারণে দ্রুত গরু দুটি বিক্রি করে দেওয়ায় আশানুরূপ দাম পাননি বলে জানান। পাবনার খামারি শোয়েব বলেন, ‘এত টাকা বিনিয়োগ করে যদি কোরবানির ঈদে গরুর দাম ভালো না পাই তাহলে আমাদের খামারিদের দুঃখের সীমা থাকবে না। গরু পালন করতে গিয়ে অনেকের লোন হয়েছে। ধারদেনা করে কোরবানির আশায় গরু পালন করেছি। করোনার বর্তমান অবস্থায় এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা : স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় কোরবানির হাট বসাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে, সড়ক/মহাসড়কের পাশে পশুর হাট বসানো যাবে না। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনা ও কোরবানিকালে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রণীত গাইডলাইন অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার একমুখী চলাচল থাকতে হবে। অর্থাৎ প্রবেশপথ এবং বহির্গমনের পথ পৃথক হতে হবে।
পাশাপাশি সবাই যাতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্দেশনায় আরও রয়েছে, ক্রেতা-বিক্রেতা প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র এবং হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত বেসিন, পানি এবং জীবাণুনাশক সাবান রাখতে হবে। পশুর হাটে সামাজিক দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়ানো, প্রবেশ-বের হওয়া এবং পর্যাপ্ত সময় রেখে পশু ক্রয়, বৃদ্ধ ও শিশুদের পশুর হাটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশু জবাইয়ের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্থান নিশ্চিত করতে হবে। বর্ষাকাল বিবেচনায় শামিয়ানা/ত্রিপল টাঙাতে হবে। পশুর হাটে ভেটেরিনারি চিকিৎসক/ সার্জনের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মোটাতাজাকরণকৃত/রোগমুক্ত গরু সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও প্রতিটি হাটে একটি বুথ স্থাপন করতে হবে। কভিড-১৯ প্রতিরোধকল্পে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইমামদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার চালাতে হবে।