দু-তিন মাস আগে ভারতের বেঙ্গালুরুতে পায়ের অস্ত্রোপচার করে দেশে ফেরেন মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী (৬৫)। এরপর সুস্থই ছিলেন। কিন্তু গত ৩০ মে হঠাৎ তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখা যায়, তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। স্বজনেরা দ্রুত তাঁকে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছোটেন। কিন্তু সেখানে করোনা ওয়ার্ডে শয্যা খালি ছিল না। অনেক চেষ্টার পর অন্য একটি ওয়ার্ডে শয্যা খালি পাওয়া যায়, তবে তাতে ছিল এক রোগীর মরদেহ। সেই মরদেহ সরিয়ে ওই শয্যায় তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়। পরানো হয় অক্সিজেনের মাস্ক। কিন্তু এত চেষ্টা সব বিফলে যায় ১৫ মিনিটের মধ্যে। মারা যান ইউসুফ আলী।
শুধু ইউসুফ আলীই নন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা সংক্রমিত এমন অনেক রোগীই আসছেন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার পর। এ কারণে অনেকেরই প্রয়োজন হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে করোনা ইউনিটে শয্যাসংকটের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ রোগীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভর্তির পর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার আর বেশি সময় হাতে থাকছে না।
রাজশাহী মেডিকেলে অনেক রোগীই আসছেন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার পর। এ কারণে মৃত্যু বেশি
হাসপাতাল সূত্র বলেছে, গত ১২ দিনে (গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯৩ জন। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন ৫৬ জন। মারা যাওয়া রোগীদের অর্ধেকের বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই ভর্তি হওয়ার চার দিনের মধ্যে মারা গেছেন। সবারই সমস্যা ছিল অক্সিজেন ঘাটতি। মারা যাওয়া অন্তত ১৫ জন রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের চিকিৎসার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে অক্সিজেনের ঘাটতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে আইসিইউ শয্যা আছে ১৭টি। অথচ গত বৃহস্পতিবার সকালে আইসিইউ শয্যার চাহিদা ছিল ৭৭টি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এবার সব রোগীরই অক্সিজেন দরকার পড়ছে। আমাদের রোগী পরিবহনব্যবস্থা ভালো নয়। যেমন একজন রোগীকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, ওই হাসপাতালে রোগী একটা অক্সিজেন সাপোর্টে ছিল। পথে অক্সিজেনের অভাবে তার হার্ট ও ব্রেনের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলেও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীকে আর সুস্থ করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সদর হাসপাতালে আগে ২০ জন করে করোনা রোগী ভর্তি করা যেত। গত বুধবার থেকে তা বাড়িয়ে ৩০ জন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন অক্সিজেন বেশি লাগছে। অক্সিজেনের সরবরাহ না বাড়ালে এর বেশি রোগী তাঁরা ভর্তি নিতে পারবেন না।
ইউসুফ আলীর মৃত্যু ভর্তির ১৫ মিনিটে
মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীর (৬৫) বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের নয়াগলা গ্রামে। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আলী বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে না পেরে তাঁরা ইউসুফ আলীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ৩০ মে বেলা তিনটার দিকে তাঁর বাবাকে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তাঁরা। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে জানতে পারেন, তাঁর বাবার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ভারত থেকে ফেরার পর তিনি সুস্থই ছিলেন। ৩০ মে হঠাৎ তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে স্বজনদের শুরু হয় তাঁকে নিয়ে হাসপাতাল ছোটাছুটি।
মোহাম্মদ আলী বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যে চিকিৎসক ছিলেন, তাঁর ব্যবহার যথেষ্ট ভালো। করোনা ওয়ার্ডে শয্যা খালি না থাকায় ওই চিকিৎসকের পরামর্শেই তাঁরা ২২ নম্বর ওয়ার্ডে যান। সেখানে একজন রোগী মারা গেছেন। ওই শয্যায়ই তাঁর বাবাকে তোলার কথা। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখেন ওই রোগীর মরদেহ তখনো শয্যায়ই রয়েছে। নামানোর লোক নেই। মৃত ব্যক্তির স্বজনেরাও তখন সেখানে ছিলেন না।
ইউসুফ আলীর ছেলে অভিযোগ করেন, ভেতরে একজন নার্স ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি। উল্টো দুর্ব্যবহার করেছেন। শেষে সন্ধ্যার দিকে নিজেরাই লাশটি একটি ট্রলিতে রেখে শয্যাটি জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর তাঁর বাবাকে শুইয়ে দেন। ওই নার্স অক্সিজেন মাস্কও পরাতে আসেননি। অবশ্য একজন চিকিৎসক ওষুধ ও ইনজেকশন লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ওষুধ খাওয়ানোর সময় পাওয়া যায়নি। অক্সিজেন দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে মারা যান ইউসুফ আলী।
সময় দেননি সুব্রত শর্মাও
সুব্রত শর্মার বয়স মাত্র ২৫ বছর। রাজশাহী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর মা পূর্ণিমা শর্মা বলেন, তাঁর ছেলের কিছুদিন আগে হঠাৎ জ্বর হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করে জানা গেল, সুব্রত করোনায় সংক্রমিত। অবস্থা খারাপ হওয়ায় গত মঙ্গলবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। এরপর তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হয়। তিনি বলেন, ‘আইসিইউতে গিয়ে দেখি, মানুষ খালি মরে মরে বের হচ্ছে। ছেলেকে আইসিইউতে নেওয়া হলো। গত বৃহস্পতিবার ভোরেও ছেলে কথা বলেছে। কিন্তু তার কথা জড়াইয়ে আসছিল। সকালেই ছেলে মারা যায়।’
হারুনের অক্সিজেনের মাত্রা ৬৫-তে নেমে যায়
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের হারুন অর রশিদের (৬০) ডায়াবেটিস ছিল। ঈদের পরদিন টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। ডায়াবেটিসও বেড়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে রাজশাহী ডায়াবেটিক হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। হারুনের ভাতিজা আবদুল মুকিত বলেন, রাজশাহী নেওয়ার পর দেখা যায়, তাঁর চাচার অক্সিজেনের মাত্রা ৬৫-তে নেমে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ছয় দিন পর গত ২৯ মে তিনি মারা যান।
অক্সিজেন লেভেল ওঠেনি
নিয়ামত আলীর (৭০) বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কানইল গ্রামে। জ্বর হওয়ায় গত ২৮ মে নিয়ামতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর জামাতা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২৮ মে রাত ১০টার দিকে তাঁর শ্বশুরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরদিন সকালে চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা ৫০-এর নিচে নেমে গিয়েছিল। ৩০ মে সকালে তাঁকে আইসিইউতে নিতে বলা হয়। কিন্তু সেখানে শয্যা খালি ছিল না। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় পরদিন। জানা যায়, নিয়ামত করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন।