জন্মকথার সূত্র অনুযায়ী গণনা আর ইতিহাসের বিবেচনায় বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে গ্রিক রাশির জন্মকথা সত্যিই অনেক বেশি আগ্রহ-উদ্দীপক। কারণ এর গল্প কোনো অংশেই রূপকথার চেয়ে কম নয়। ১২টি রাশির ১২টি প্রতীক একেকটি পৌরাণিক গল্পকে ধারণ করে। এই আয়োজনে আসুন জেনে নিই সেই গল্পগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ
মেষ :এই তারকামণ্ডলীকে ভেড়া হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। গ্রিক পুরাণ অনুসারে, রাজপুত্র ফ্রিসোস ও তার বোনকে যখন তাদের সত্ মা ইনো হত্যা করার পরিকল্পনা করে, তখন মেঘের দেবী নেফেলের নির্দেশে একটি সোনালি বর্ণের ভেড়া তাদের উদ্ধার করে কোলকাইস দেশে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজপুত্র ঈশ্বরকে খুশি করতে তার প্রিয় ভেড়াটিকে বলি দিয়ে তার চামড়া মন্দিরে টাঙিয়ে দেয়।
বৃষ :এই তারকামণ্ডলীর বিন্দুগুলোকে যোগ করলে অনেকটা ষাঁড়ের মতো দেখায়। তাই বৃষমণ্ডলীকে ষাঁড় হিসেবে ভাবা হয়। এই ষাঁড়টি আর কেউ নন, স্বয়ং দেবরাজ জিউস। তিনি রাজকুমারী ইউরোপাকে হরণ করতে একবার একটি সাদা ষাঁড়ের রূপ ধারণ করেছিলেন। বৃষ রাশির অবস্থান কালপুরুষের উত্তর-পশ্চিমে। রাশির প্রধান তারকা রোহিণী। ২০ অক্টোবর-৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই তারকামণ্ডলী থেকে উল্কাপাত হয়।
মিথুন :মিথুন অর্থ যমজ। জিউসের দুই যমজ ছেলে—ক্যাস্টোর ও পোলাক্স। গ্রিকপুরাণ বলে, এই দুই ভাই গৃহস্থের পশু চুরি করতে পারদর্শী ছিল। আরেক পুরাণকথার সঙ্গে এই কথার মিল আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ছায়াপথ হলো দুগ্ধ গরুর পাল। জ্যোতির্মণ্ডলের দিকে তাকালে অনেক সময় দেখা যায়, মিথুন রাশির তারকামণ্ডলীর একাংশ ছায়াপথের মধ্যে আর বাকি অংশ ছায়াপথের বাইরে অবস্থান করছে। এর গল্প হলো, এক ভাই গরু চুরি করছে, আরেক জন পাহারা দিচ্ছে।
কর্কট :এই রাশির প্রতীক কাঁকড়া। জিউসপুত্র হারকিউলিস যখন একাধিক মাথাওয়ালা দানব হাইড্রার সঙ্গে যুদ্ধ করছিল, তখন হারকিউলিসের শত্রু দেবী হেরা একটি কাঁকড়া পাঠায় হারকিউলিসকে বাধা দিতে। কাঁকড়া এসে কামড় বসায় হারকিউলিসের হাঁটুতে। যুদ্ধে বাধা পড়ায় হারকিউলিস ভীষণ বিরক্ত হয়ে কাঁকড়াটিকে পিষে মারে। কিন্তু দেবী হেরা তার প্রিয় কাঁকড়াটিকে জ্যোতির্মণ্ডলে স্থান দেন। কর্কট তারকামণ্ডলী দেখতে কিছুটা কাঁকড়া আকৃতির। এটি রাশিচক্রের তারকামণ্ডলীর মধ্যে সবচেয়ে অস্পষ্ট।
সিংহ :গ্রিসের নিমিয়া নগর দখল করে রেখেছিল একটি দানব সিংহ। পুরাণশাস্ত্রে এটি নিমিয়ান সিংহ নামে পরিচিত। সিংহটি নগরে আতঙ্ক তৈরি করে রেখেছিল। বীর হারকিউলিস ভ্রমণ করতে করতে নিমিয়ায় পৌঁছায়। হারকিউলিস সিংহটিকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে সেই দানব সিংহটিও আকাশে স্থান পায়।
কন্যা :গ্রিক ও রোমান পুরাণ মতে, দেবী দিমিটার জিউসের ঔরসে কুমারী মা হিসেবে জন্ম দেন পারসেফোনিকে। শস্য ও উর্বরতার দেবী কুমারী মা দিমিটারের অবয়বই দেখা যায় কন্যামণ্ডলীতে। অন্য এক পুরাণ অনুসারে, কন্যা রাশি কুমারী দেবী ইউসতিশিয়ার প্রতীক। তুলা রাশির মতো এই দেবীর হাতেও দাঁড়িপাল্লা রয়েছে। চিত্রা, নাভিতারা, দ্রাক্ষাহরণী এই তারকামণ্ডলীর উল্লেখযোগ্য তারকা।
তুলা :গ্রিকদের সুবিচারের দেবী জিউসকন্যা অ্যাস্ট্রিয়া। তার এক হাতে একটি দাঁড়ি-পাল্লা নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে শোভা পায়। এই দেবীকেই গ্রিকরা তুলা রাশি চক্রের তারকামণ্ডলী হিসেবে জ্যোতির্মণ্ডলে কল্পনা করত। জ্যোতির্মণ্ডলের সবচেয়ে প্রাচীন নক্ষত্র স্তবক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এই রাশির তারকামণ্ডলী। এর আবরণী জোড়া এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু।
বৃশ্চিক :সমুদ্ররাজ পসিডনের সুদর্শন পুত্র অরিয়ন, যে মেয়ে তাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। বাদ যায় না স্বয়ং প্রেমের দেবী আরোরাও। মানুষের গর্ব দেবতারা সহ্য করবেন কেন? অরিয়ন ছিল দাম্ভিক প্রকৃতির ছেলে। জিউসপুত্র দেবতা অ্যাপোলোর বোন আর্টেমিসও অরিয়নের প্রেমে পড়ে। অ্যাপোলো তা মেনে নিতে পারে না। অরিয়নের অহংকার চূর্ণ করতে অ্যাপোলো একটি বৃশ্চিক বা বিছা পাঠায়। অরিয়নের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে দংশন করতে বৃশ্চিককে আদেশ করা হয়। বৃশ্চিকের হাত থেকে রক্ষা পেতে অরিয়ন সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। তবুও রক্ষা হয়নি, আর্টেমিসেরই হাতে অরিয়ন ভুল করে নিহত হয়। আজ্ঞাবহ বৃশ্চিকটি আকাশে স্থান পায়।
ধনু :ফিলিরা ও শনির পুত্র কাইরন। কাইরনের হিংসুটে স্ত্রী রিয়া। কাইরন তার এই হিংসুটে বউয়ের কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেতে একদিন মন্ত্রবলে এক অদ্ভুত রূপ ধারণ করে। অর্ধেক অশ্ব অর্ধেক মানুষ। কোমরের উপর দিকটা মানুষের মতো, আর নিচের দিকটা দেখতে ঘোড়ার মতো। কাইরনের ঘোড়ার মতো চার পা আছে, হাতে আছে তীর-ধনুক। ধনু রাশির তারকামণ্ডলীকে দেখে এই গল্পই বানিয়েছিল পুরাকালের গ্রিকরা।
মকর :গ্রিকপুরাণে মকরমণ্ডলকে অনেক সময় অ্যামলথিয়া নামের ছাগল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যে কিনা দেবরাজ জিউসের দুধমাতা। অ্যামলথিয়া জিউসকে দুধ পান করিয়েছিলেন। দেবরাজের দুধমাতা বলেই তিনি আকাশে স্থান পান। আরেকটি গল্প হলো, ছাগলের মতো দেখতে দেবতা প্যানকে দানব টাইফন আক্রমণ করতে এলে প্যান নদীতে আশ্রয় নেন। তখন তার শরীরের যে অংশ পানিতে ডুবে ছিল সে অংশ মাছের আকৃতি ধারণ করে।
কুম্ভ :ট্রয়ের গনিমেডে ছিল এক অতি সুন্দরী যুবতী। দেবরাজ জিউস তার প্রেমে পড়েন। তিনি ঈগলের ছদ্মবেশে অপহরণ করে স্বর্গে নিয়ে যান এই যুবতীকে। গনিমেডেকে দেবতাদের পেয়ালায় মদ তুলে দেওয়ার কাজে লাগানো হয়। এজন্যই কুম্ভ রাশি চক্রের তারকামণ্ডলীর চিহ্ন হিসেবে আমরা দেখি একজন পাত্র থেকে পানি জাতীয় কিছু ঢালছে। অন্য স্থানে বলা হয়েছে, কুম্ভ হলো জলের ধারক। যিনি পৃথিবীতে বন্যা দেন এবং নদীগুলো ভরাট করেন। শুধু তাই নয়, তিনিই গ্রিকপুরাণের সেই মহাপ্লাবনের হেতু।
মীন :একদিন দানব টাইফন দেবতাদের রাজ্য অলিম্পাস দখল করতে মনস্থ করলেন। অতর্কিতে হামলা চালাল একদিন। দেবতারা জন্তুর রূপ নিয়ে পালিয়ে রক্ষা পেলেন। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি ও তার পুত্র কিউপিড চরম অসহায় অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আফ্রোদিতিস নদীতে নেমে উভয়ে মাছের রূপ ধরে পালিয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে সেই জোড়া মাছও আকাশে স্থান পায়।